ফিচার ডেস্ক
প্রকৃতি বরাবরই আমাদের আশ্চর্য করার ক্ষমতা রাখে, তা আমরা নানা সময়ে বুঝতে পারি। তবে আফ্রিকার কালাহারি মরুভূমিতে সোশ্যাবল উইভার পাখির তৈরি বিশাল আকৃতির বাসা এক ভিন্নমাত্রার বিস্ময় সৃষ্টি করে। পাখির বাসা বলতে আমরা মূলত বুঝি অল্প পরিসরে খড়কুটো দিয়ে তৈরি ছোট্ট খোঁপ। কিন্তু সোশ্যাবল উইভার পাখিরা এই ধারণাকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। এই পাখিরা দলবদ্ধভাবে এমন বাসা তৈরি করে যা আকারে বিশাল।

প্রথমেই জানা যাক এই উইভার পাখির পরিচয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Philetairus socius. একটি ছোট, বাদামি রঙের পাখি। যা মূলত দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া এবং বতসোয়ানার কালাহারি অঞ্চলে দেখা যায়। এদের দৈহিক আকার খুব সাধারণ– প্রায় ১৪ সেন্টিমিটার দীর্ঘ এবং গড়পড়তা ওজন ২৫-৩০ গ্রাম। তবে এদের আসল বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে আছে তাদের আচরণে ও গোষ্ঠীগত জীবনধারায়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো, এই পাখিরা অত্যন্ত সামাজিক এবং এদের জীবনযাপন ও বাসা নির্মাণের পদ্ধতিও সমাজভিত্তিক। ‘’সোশ্যাবল” শব্দটিও এসেছে তাদের দলবদ্ধ থাকার প্রবণতা থেকেই। এরা একসঙ্গে বাস করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সোশ্যাবল উইভার পাখির বাসা দেখতে অনেকটা ছাউনি বা খড়ের তৈরি বিশাল ছাদের মতো, যার নিচে অসংখ্য ছোট ছোট প্রকোষ্ঠ থাকে। একটি বাসার ওজন কয়েক শ কিলোগ্রাম হতে পারে এবং এটি ৭-১০ ফুট পর্যন্ত চওড়া হতে পারে। এই বাসাগুলো অনেকগুলো ছোট ছোট ঘরের সমন্বয়ে গঠিত, যেখানে প্রতিটি ঘর একেকটি জোড়া পাখির জন্য নির্ধারিত থাকে। প্রতিটি বাসা গড়ে তোলা হয় শুকনো ঘাস, ডালপালা এবং গাছের ছাল দিয়ে। সোশ্যাবল উইভার পাখির একটা বাসা বহু বছর টিকে থাকে। এটি কেবল একটি বসবাসের স্থান নয়, বরং এক ধরনের প্রজন্মান্তরীয় বসতিও হয়ে ওঠে। এক প্রজন্মের পর পরবর্তী প্রজন্মও সেই বাসায় থাকে এবং তার সঙ্গে নতুন অংশ
যুক্ত করে।
এই বাসাগুলো সাধারণত প্রাচীন বড় গাছের ডালে কিংবা বৈদ্যুতিক খুঁটিতে হয়ে থাকে। ফলে শিকারি প্রাণীদের হাত থেকে নিরাপদ থাকা যায়। একটি বাসায় শতাধিক পৃথক প্রকোষ্ঠ থাকে এবং এক সঙ্গে প্রায় ২০০-৩০০টি পাখি এতে বাস করে। বাসার নিচের দিকে থাকে অসংখ্য প্রবেশপথ, যেগুলো সোজা ভিতরের প্রকোষ্ঠগুলোতে পৌঁছে দেয়। এই প্রবেশপথগুলো সাধারণত সরু এবং গোলাকৃতির, যাতে শত্রু বা শিকারি সহজে ঢুকতে না পারে। বাসার ভিতরের প্রতিটি প্রকোষ্ঠ আলাদা হলেও, বাইরে থেকে এটি সমন্বিত ও একীভূত গঠন দেখায়।
কালাহারি মরুভূমিতে দিনে প্রচণ্ড গরম এবং রাতে তীব্র ঠাণ্ডা পড়ে। এই কঠিন আবহাওয়ায় টিকে থাকতে হলে বাসাকে হতে হয় জলবায়ু-সহনশীল। সোশ্যাবল উইভারদের বাসাগুলো এই দিক থেকে অসাধারণ। বাসার গঠন এমনভাবে তৈরি করা হয় যে, দিনের তাপ ভিতরে প্রবেশ করে না এবং রাতে ঠাণ্ডা বাতাস ভিতরে আসতে পারে না। এর ফলে বাসার ভিতরের তাপমাত্রা প্রায় সারা দিন ধরে স্থিতিশীল থাকে। এটি প্রাকৃতিক তাপ নিরোধক ব্যবস্থার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
এই পাখিদের আরেকটি চমকপ্রদ বিষয় হলো এদের সামাজিক আচরণ ও দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার ব্যাপার। সোশ্যাবল উইভার পাখিদের মধ্যে অসাধারণ সামাজিক সম্পর্ক বিদ্যমান। তারা শুধু একসঙ্গে বাসা বানায় না, বরং বাসার রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত, নতুন প্রকোষ্ঠ নির্মাণ, খাদ্য খোঁজা এবং বাচ্চাদের লালন-পালনে একে অপরকে সাহায্য করে। বাসার পুরাতন অংশগুলো সময়ের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হলে নতুন করে তা মেরামত করা হয় দলগতভাবে। কোনো একটি জোড়া নতুন বাসিন্দা হলে তারা পুরোনো বাসাসংলগ্ন একটি নতুন প্রকোষ্ঠ তৈরি করে সংযুক্ত করে ফেলে। এভাবে একটি বাসা বছরের পর বছর ধরে ধীরে ধীরে বিশাল আকার ধারণ করে এবং এক ধরনের ‘পাখিদের শহর’ তৈরি হয়।
এতকিছুর পরও বিপদের আশঙ্কা থেকেই যায়; যেমন- অনেক সময় কিছু শিকারি পাখি সুযোগ বুঝে বাসায় ঢুকে ডিম বা ছানা খেয়ে ফেলে। তখন সোশ্যাবল উইভাররা দলবদ্ধভাবে এসব বিপদের মোকাবিলা করে এবং পরস্পরকে সতর্ক করে দেয়। সোশ্যাবল উইভার পাখির বাসা শুধু একটি আশ্রয়ের স্থান নয়, এটি একটি সামাজিক
ব্যবস্থা, একটি প্রকৃতিক প্রকৌশল এবং এক
নিখুঁত স্থাপত্য কাঠামো।
কালাহারি মরুভূমির এই পাখিরা প্রমাণ করে, প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণী তার নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলের মাধ্যমে টিকে থাকতে পারে এবং এমন কিছু সৃষ্টি করতে পারে- যা শুধু তাদেরই নয়, মানুুষদেরও অনুপ্রেরণা দেয়।