মল্লিকপুরের বটগাছের ইতিহাস, বটগাছের উৎপত্তি, "মল্লিকপুর বটগাছ" নামের উৎস

মল্লিকপুরের বটগাছের ইতিহাস, বটগাছের উৎপত্তি, “মল্লিকপুর বটগাছ” নামের উৎস

শেখ জিল্লুর রহমান

মল্লিকপুরের বটগাছের ইতিহাস একদিকে প্রকৃতির বিস্ময়, অন্যদিকে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক নিদর্শন। এই গাছটি কেবল তার আকারে নয়, বরং তার ঐতিহাসিক ও সামাজিক গুরুত্বেও উল্লেখযোগ্য।


ইতিহাস সংক্ষেপে:

অবস্থান:

  • মল্লিকপুর (বা সুইতলা), মালিয়াট ইউনিয়ন, কালীগঞ্জ উপজেলা, ঝিনাইদহ জেলা, বাংলাদেশ।

উৎপত্তি ও বিকাশ:

  • এই বটগাছটি আনুমানিক ২০০ থেকে ৩০০ বছর আগে জন্মেছিল বলে ধারণা করা হয়।

  • স্থানীয় ইতিহাস মতে, একটি মাত্র মূল বটগাছ থেকেই এই বিশাল গাছের সৃষ্টি। সময়ের সাথে সাথে এটির শত শত প্রোপ (prop) শিকড় মাটিতে গিয়ে নতুন শাখায় পরিণত হয়, যা গাছটিকে জঙ্গল সদৃশ রূপ দিয়েছে।

  • যদিও এটি দেখতে বহু গাছের বনভূমির মতো, প্রকৃতপক্ষে এটি একটি মাত্র গাছ

স্থানীয় বিশ্বাস ও কাহিনি:

  • স্থানীয় জনগণের মধ্যে এটি একটি পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য হয়। অনেকে মনে করে, এটি কোনো সাধু বা পীরের দোয়ায় জন্ম নেওয়া গাছ।

  • কিছু লোককথা অনুযায়ী, গাছটি এক সময় আশেপাশের গ্রামবাসীর মিলনস্থল এবং বিশ্রাম কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হত।

প্রাকৃতিক বিস্তার:

  • বটগাছটি বর্তমানে প্রায় ১১ একর জমি জুড়ে বিস্তৃত।

  • এটি বর্তমানে ৫২টির মতো বড় বড় মূল কাণ্ড ও শতাধিক শাখা-প্রশাখা নিয়ে একটি বিশাল ছায়াঘেরা অঞ্চল সৃষ্টি করেছে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি:

  • ১৯৮৪ সালে বিবিসি (BBC) এই গাছটিকে এশিয়ার বৃহত্তম বটগাছ হিসেবে একটি জরিপে স্বীকৃতি দেয়।

  • বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এটিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।

সামাজিক ও ধর্মীয় ভূমিকা:

  • এখানে মাঝে মাঝে স্থানীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা পিকনিক অনুষ্ঠিত হয়।

  • কিছু মানুষ মনে করে গাছটির নিচে দোয়া করলে রোগমুক্তি হয় বা মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয়।


এই গাছটি শুধু একটি প্রাকৃতিক বিস্ময় নয়, এটি স্থানীয় লোকজ সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক সম্প্রীতির প্রতীক। এর ছায়া যেমন প্রশান্তি দেয়, তেমনি ইতিহাসও ধারণ করে বহু প্রজন্মের স্মৃতি।

“মল্লিকপুর বটগাছ” নামের উৎস:

১. গ্রামের নাম অনুসারে নামকরণ:

  • এই বিশাল বটগাছটি অবস্থিত মল্লিকপুর গ্রামে, যা ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মালিয়াট ইউনিয়নের একটি মৌজা।

  • স্বাভাবিকভাবে, স্থাননির্ভর নামকরণের ধারাবাহিকতায় গাছটিকে “মল্লিকপুরের বটগাছ” নামে ডাকা শুরু হয়।

২. স্থানীয়ভাবে পরিচিত অন্যান্য নাম:

  • এটি কখনো “সুইতলার বটগাছ” নামেও পরিচিত, কারণ এলাকাটি মল্লিকপুর গ্রামের একটি অংশ যা স্থানীয়ভাবে “সুইতলা” নামে পরিচিত।

  • কেউ কেউ “বেথুলীর বটগাছ” বলেও চিহ্নিত করে, কারণ এটি বেথুলী মৌজার সীমানার কাছাকাছি।


লোকজ ব্যাখ্যা:

  • কিছু পুরনো বাসিন্দা বলেন, বহু আগে এই অঞ্চলে মল্লিক উপাধিধারী কিছু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বসবাস করতেন বা জমিদার ছিলেন, এবং সেই পরিবার থেকেই “মল্লিকপুর” নামের উৎপত্তি হতে পারে। সেই সূত্রে গাছটির নামেও “মল্লিকপুর” যুক্ত হয়।

  • আবার কেউ কেউ বলেন, এই বটগাছের চারপাশে একসময় মল্লিক পরিবার বা সম্প্রদায়ের বসতি ছিল, যেখান থেকে নামটি এসেছে।


গাছটির সাংস্কৃতিক ও প্রতীকী গুরুত্ব:

  • সময়ের সাথে গাছটি শুধু একটি প্রাকৃতিক নিদর্শন নয়, বরং মল্লিকপুর গ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠে।

  • এটি বর্তমানে মল্লিকপুর নামের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে, এবং বহিরাগত পর্যটকদের কাছে “মল্লিকপুর বটগাছ” নামেই সুপরিচিত।


সারকথা, মল্লিকপুর বটগাছ নামটি এসেছে প্রধানত তার অবস্থানভিত্তিক নামকরণ থেকে, আর কিছু লোককথা ও ঐতিহ্য এই নামকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক করে তুলেছে।

মল্লিকপুরের বটগাছের ইতিহাস, বটগাছের উৎপত্তি, "মল্লিকপুর বটগাছ" নামের উৎস
মল্লিকপুরের বটগাছের ভীতরের অংশ

উৎপত্তির সম্ভাব্য ইতিহাস:

মল্লিকপুরের বটগাছের উৎপত্তি সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো লিখিত দলিল বা প্রামাণ্য ইতিহাস নেই, তবে স্থানীয় লোককথা, মৌখিক ইতিহাস ও পরিবেশগত বিশ্লেষণ থেকে গাছটির জন্ম ও বিস্তার সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়।

১. প্রাকৃতিক বংশবিস্তার:

  • ধারণা করা হয়, প্রায় ২০০-৩০০ বছর আগে, একটি বটবীজ স্বাভাবিক উপায়ে পড়ে সেখানে অঙ্কুরোদগম করে।

  • সময়ের সাথে সেই মূল বটগাছটি বাড়তে বাড়তে এর প্রোপ রুট (ঝুরি) মাটিতে নেমে নতুন কাণ্ডে রূপান্তরিত হয়। এইভাবে একটি গাছ থেকেই গঠিত হয় বিশাল এক বৃক্ষরাজি।

২. স্থানীয় লোককথা:

  • স্থানীয় প্রবীণদের মতে, এই বটগাছটি একসময় একজন সাধু বা ফকির এখানে আশ্রয় নেন এবং তার বসত স্থানের পাশেই গাছটি জন্মে। গাছটি তখন থেকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং পূজ্য হয়ে ওঠে।

  • কেউ কেউ বলেন, এটি কোনো ধর্মীয় আশ্রম বা বিশ্রামস্থলের পাশে রোপণ করা হয়েছিল—যেখানে পথচারীরা বিশ্রাম নিত।

৩. ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক দিক:

  • বটগাছের বৃদ্ধি ও বংশবিস্তারের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হল—এর ঝুরি মাটিতে গিয়ে নতুন গাছের মতো কাণ্ড তৈরি করে। এই কারণে একটি গাছ অনেক জায়গা জুড়ে বিস্তৃত হতে পারে। মল্লিকপুরের এই বটগাছও তেমনই এক প্রকৃতির নিদর্শন।

  • বর্তমানে এটি প্রায় ১১ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত।


উৎপত্তির প্রতীকী অর্থ:

  • স্থানীয়দের কাছে এই গাছ প্রাচীনত্ব, স্থিতি ও ঐক্যের প্রতীক

  • অনেকে মনে করে, গাছটির এই বিশালতা একটি ঐশ্বরিক আশীর্বাদ, যা এলাকা ও মানুষকে ছায়া, শান্তি ও ঐতিহ্য দিয়েছে।


গবেষণার সম্ভাবনা:

  • যদি এই গাছের জেনেটিক বিশ্লেষণ বা বোটানিক্যাল স্টাডি করা হয়, তাহলে এর বয়স ও প্রাথমিক উৎপত্তি সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেতে পারে। https://youtu.be/zUafOvjypBo

Scroll to Top