মনুষের দায়িত্ব ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও মনুষের দায়িত্ব

শেখ জিল্লুর রহমান

সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষ তথা সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে নিয়ম শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করাও মানুষের অন্যতম দায়িত্ব। মহান আল্লাহতায়ালার ইবাদত বন্দেগীর পাশাপাশি পৃথিবী নামক গ্রহে তার হুকুম আহকাম মানব সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করা আমাদের অন্যতম দায়িত্ব ও গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান।

আরবি শব্দ ‘আদল’ এর অর্থ হচ্ছে ভারসাম্য বজায় রাখা বা ন্যায়বিচার করা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় ব্যক্তি ও মানব জীবনের সব শাখায় শরিয়তসম্মত জীবন বিধানে যার যে হক বা পাওনা তা আদায়ের সুব্যবস্থা করা সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডকে ‘আদল’ বলা হয়। অত্যাচারের প্রতিবিধান এবং বিচারে ন্যায়ের মানদনণ্ড এমনভাবে ধারণ করা, যাতে পক্ষদ্বয়ের কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব না হয়; এটাও আদল। বস্তুত, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কথাবার্তা, কাজকর্ম আচার-আচরণ, ন্যায়-নীতি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা ফরজ। যেহেতু ইসলাম ন্যায় বিচার করার নির্দেশ দিয়েছে, তাই আদলই হলো ন্যায়বিচারের একমাত্র উপায়। আর ন্যায়নীতি অনুযায়ী বিচারকার্য সম্পাদনা করাই হলো ইনসাফ। এর বিপরীত হলো বে-ইনসাফ।

ন্যায় বিচার সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা ন্যায় বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাক, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাক্ষ্য দাও; যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়। সে বিত্তবান হোক অথবা বিত্তহীনই হোক, আল্লাহ উভয়েরই যোগ্যতর অভিভাবক। সুতরাং তোমরা ন্যায়-বিচার করতে খেয়াল-খুশীর অনুগামী হয়ো না। যদি তোমরা পেঁচালো কথা বল অথবা পাশ কেটে চল, তাহলে (জেনে রাখ) যে, তোমরা যা কর, আল্লাহ তার খবর রাখেন। (সূরা: আন-নিসা ১৩৫)

যে সমাজে এই সুবিচারের যত্ন নেওয়া হবে, সে সমাজ হবে নিরাপদ ও শান্তির আধার এবং আল্লাহর পক্ষ হতে সেখানে অজস্র রহমত ও বরকত অবতীর্ণ হবে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এ বিষয়টিকে খুব ভালোভাবেই হৃদয়ঙ্গম করে নিয়েছিলেন। সুতরাং আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) সম্পর্কে এসেছে যে, রসূল (সাঃ) তাঁকে খায়বারের ইয়াহুদীদের নিকট পাঠালেন, সেখানকার ফলসমূহ ও ফসলাদি অনুমান করে দেখে আসার জন্য। ইয়াহুদীরা তাঁকে ঘুষ পেশ করল; যাতে তিনি তাদের ব্যাপারে একটু শিথিলতা প্রদর্শন করেন। তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি তাঁর পক্ষ হতে প্রতিনিধি হয়ে এসেছি যিনি দুনিয়ায় আমার কাছে সব থেকে বেশী প্রিয়তম এবং তোমরা আমার নিকট সর্বাধিক অপ্রিয়। কিন্তু স্বীয় প্রিয়তমের প্রতি আমার ভালোবাসা এবং তোমাদের প্রতি আমার শত্রুতা আমাকে তোমাদের ব্যাপারে সুবিচার না করার উপর উদ্বুদ্ধ করতে পারবে না।’ এ কথা শুনে তারা বলল, ‘এই সুবিচারের কারণেই আসমান ও যমীনের শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনা সুপ্রতিষ্ঠিত রয়েছে।’ (ইবনে কাসীর)

সুবিচার বলতে মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন, অবশ্যই আমরা আমাদের রাসূলগণকে পাঠিয়েছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও ন্যায়ের পাল্লা, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে।আমরা আরও নাযিলকরেছি লোহা যাতে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি এবং রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধা কল্যাণ।এটা এ জন্যে যে, আল্লাহ প্রকাশ করে দেন কে গায়েব অবস্থায়ও তাকে ও তাঁর রাসূলগণকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ মহা শক্তিমান, পরাক্রমশালী। (সূরা হাদিদ, আয়াতা: ২৫)

আয়াতে কিতাবের ন্যায় মিযানের বেলায়ও নাযিল করার কথা বলা হয়েছে। কিতাব নাযিল হওয়া এবং ফেরেশতার মাধ্যমে নবী-রাসূলগণ পর্যন্ত পৌছা সুবিদিত। কিন্তু মিযান নাযিল করার অর্থ কি? এ সম্পর্কে বিভিন্ন তাফসীরে বিভিন্ন উক্তি এসেছে, কোন কোন মুফাসসির বলেন, মীযান নাযিল করার মানে দাঁড়িপাল্লার ব্যবহার ও ন্যায়বিচার সম্পর্কিত বিধানাবলী নাযিল করা। কারও কারও মতে, প্রকৃতপক্ষে কিতাবই নাযিল করা হয়েছে, কিন্তু এর সাথে দাঁড়িপাল্লা স্থাপন ও আবিষ্কারকে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। কাজেই আয়াতের অর্থ যেন এরূপ আমি কিতাব নাযিল করেছি ও দাড়িপাল্লা উদ্ভাবন করেছি। তাছাড়া আয়াতে কিতাব ও মিযানের পর লৌহ নাযিল করার কথা বলা হয়েছে। এখানেও নাযিল করার মানে সৃষ্টি করা হতে পারে। পবিত্র কুরআনের এক আয়াতে চতুষ্পদ জন্তুদের বেলায়ও নাযিল করা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। [সূরা আয-যুমার: ৬] অথচ চতুষ্পদ জন্তু আসমান থেকে নাযিল হয় না-পৃথিবীতে জন্মলাভ করে। সেখানেও সৃষ্টি করার অর্থ বোঝানো হয়েছে। তবে সৃষ্টি করাকে নাযিল করা শব্দে ব্যক্ত করার মধ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, সৃষ্টির বহুপূর্বেই লওহে-মাহফুযে লিখিত ছিল—এ দিক দিয়ে দুনিয়ার সবকিছুই আসমান থেকে অবতীর্ণ। [কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর]

মহান আল্লাহঅন্যত্র বলছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে সদা দন্ডায়মান হও। কোনো কওমের প্রতি শত্রম্নতা যেন তোমাদেরকে কোনোভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আলস্নাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আলস্নাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত। (সূরা মায়োদা : ৮)’

‘নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের মধ্যে কোনো বিচার-ফয়সালা কর, তখন ইনসাফভিত্তিক ফয়সালা কর। (সূরা আননিসা : ৫৮)’

অন্য সূরায় মহান আলস্নাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আলস্নাহতায়ালা ন্যায়বিচার, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দিয়েছেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অপছন্দনীয় কাজ এবং অবাধ্য হতে নিষেধ করেছেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা স্মরণ রাখ। (সূরা আননহল : ৯০) যারা আলস্নাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করে না তারাই কাফের। (সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৪)’

হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন : নিশ্চয়ই যারা ইনসাফ ও ন্যায়বিচার করে আলস্নাহর কাছে তারা নূরের মিম্বরে আসন গ্রহণ করবে। তারা হচ্ছে এমন সব লোক যারা তাদের বিচার ফায়সালার ক্ষেত্রে পরিবার-পরিজনের ব্যাপারে এবং যেসব দায়-দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পণ করা হয়; সেসব বিষয়ে ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার করে। (সহিহ মুসলিম)।

ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, যে সমাজে মানুষ ইনসাফ ও ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়, সেখানে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়। ক্ষুধাপীড়িত মানুষ বিদ্যমান আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারায়। ধর্ম-বর্ণ-দল-গোষ্ঠী নির্বিশেষে মানুষ যখন তার অধিকার বুঝে পায় না, তখন অধিকারের জন্য সে সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। প্রাপ্য অধিকার যখন ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তখন সমাজে এর নানা উপসর্গ দেখা দেয়। চূড়ান্ত বিবেচনায় তা কারো জন্য কল্যাণকর হয় না। তাই ইসলাম ইনসাফ ও সাম্যের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করে। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা প্রচেষ্টা করা উচিত।

মহান আল্লাহতায়ালার দেওয়া সহজ কিছু বিধান মানাএবং নিজের কর্মকাণ্ডের বিপরীত যাওয়া বিধান না মেনে পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ সম্ভব না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, হে মুমিনগণ, তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না । নিশ্চয় সে তোমাদের জন্য স্পষ্ট শত্রু। সূরা: আল-বাকারা, আয়াত: ২০৮

মানুষকে অযাথা সৃষ্টিকরা হয়নি প্রত্যেকে দায়িত্বশীল, আল্লাহতায়ালা মানুষকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব-কর্তব্য দিয়ে দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে।এপ্রসঙ্গেআল্লাহতায়ালাবলেন “মানুষ কি ধারণা করে যে, তাদেরকে এমনিতেই ছেড়ে দেওয়া হবে?” (সূরা আল-কিয়ামাহ, আয়াত ৩৬)

আয়াতের অর্থ হলো, মানুষ কি নিজেকে মনে করে যে তার স্রষ্টা তাকে এ পৃথিবীতে দায়িত্বহীন করে ছেড়ে দিয়েছেন? এ-কথাটিই কুরআন মজীদের অন্য একস্থানে এভাবে বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা কাফেরদের বলবেন, “তোমরা কি মনে করেছে যে, আমি তোমাদের অনৰ্থক সৃষ্টি করেছি? তোমাদেরকে কখনো আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না?” (সূরা: আল মুমিনুন, আয়াত: ১১৫) এ দু’টি স্থানে মৃত্যুর পরের জীবনের অনিবার্যতার প্রমাণ প্রশ্নের আকারে পেশ করা হয়েছে। প্রশ্নের তাৎপর্য হলো আখেরাত যে অবশ্যই হবে তার প্রমাণ। (ইবন কাসীর)

আয়িশাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। জনৈকা মাখযুমী মহিলার চুরি সংক্রান্ত অপরাধ কুরাইশদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুললে তারা বললো, এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে কে আলোচনা করবে? তারা বললো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয় পাত্র উসামা ইবনু যায়িদই এ প্রসঙ্গে কথা বলতে সাহস করতে পারে। অতঃপর উসামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট একথা বলাতে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ হে উসামা! তুমি কি মহান আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি মওকুফের সুপারিশ করছো? অতঃপর তিনি ভাষণ দিতে দাঁড়িয়ে বলেনঃ তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির এজন্য ধ্বংস হয়েছে যে, তাদের মধ্যকার মর্যাদাশীল কেউ চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিতো, আর তাদের দুর্বল কেউ চুরি করলে তার উপর শাস্তি বাস্তবায়িত করতো। আমি আমার আল্লাহর কসম করে বলছি! মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাহও যদি চুরি করতো, তাহলে অবশ্যই আমি তার হাত কাটতাম। (বুখারী, মুসলিম; হাদিস: ৪৩৭৩)

লেখক: সংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

Scroll to Top