ঝিনেদার কাগজ ডেস্ক
ঝিনাইদহ জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভৌগোলিক সীমানা, প্রশাসনিক বিভাগ, জনসংখ্যা, নদ-নদী, কৃষি, অর্থনীতি, দর্শনীয় স্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কৃতী ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হলো:
✅ ইতিহাস ও ঐতিহ্য:
ঝিনাইদহ জেলার ইতিহাস একটি সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় ইতিহাস, যা প্রাচীন সভ্যতা, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, এবং মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা—এই তিনটি প্রধান পর্বের মাধ্যমে গঠিত।
ঝিনাইদহ জেলার নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন জনশ্রুতি ও ইতিহাস রয়েছে, যা এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যকে প্রতিফলিত করে।
নামের উৎপত্তি: “ঝিনুক” ও “দহ”
একটি প্রচলিত মত অনুযায়ী, “ঝিনাইদহ” নামটি এসেছে “ঝিনুক” (মুক্তা উৎপন্নকারী শামুক) এবং “দহ” (পানি বা জলাশয়) শব্দ দুটি থেকে। প্রাচীনকালে নবগঙ্গা নদীর তীরে ঝিনুক কুড়ানো শ্রমিকদের বসতি গড়ে ওঠে। ঝিনুক সংগ্রহ ও চুন তৈরির জন্য এই স্থানটি পরিচিতি লাভ করে। আঞ্চলিক ভাষায় “ঝিনুক” কে “ঝিনেই” বলা হতো, আর “দহ” অর্থে বড় জলাশয় বোঝায়। এই দুটি শব্দ মিলিয়ে “ঝিনুকদহ” বা “ঝিনেইদহ” থেকে পরবর্তীতে “ঝিনাইদহ” নামের উৎপত্তি হয় ।
ইংরেজ সাহেব ও নামকরণের কিংবদন্তি
আরেকটি জনশ্রুতি অনুযায়ী, ব্রিটিশ শাসনামলে এক ইংরেজ কর্মকর্তা নবগঙ্গা নদী পার হওয়ার সময় নদীতে ঝিনুক কুড়াতে থাকা লোকদের কাছে এলাকার নাম জানতে চান। লোকেরা তার কথা বুঝতে না পেরে ভাবেন তিনি তাদের কুড়ানো বস্তুটির নাম জানতে চাচ্ছেন, তাই তারা “ঝিনুক” বলে উত্তর দেন। ইংরেজ কর্মকর্তা তখন স্থানটির নাম “ঝিনুক” বা “ঝিনেই” বলে ধরে নেন, যা পরবর্তীতে “ঝেনিদা” এবং শেষে “ঝিনাইদহ” নাম ধারণ করে ।
️ প্রশাসনিক ইতিহাস
ঝিনাইদহ একসময় যশোর জেলার একটি মহকুমা ছিল। ১৮৬২ সালে এটি মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয় । স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝিনাইদহ জেলা ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। এই জেলার নামকরণ সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। কথিত আছে যে, ক্যালসিয়াম উৎপাদনের জন্য ‘নবগঙ্গা’ নদী এবং ‘দহা’ নদী থেকে ঝিনুক সংগ্রহের জন্য এই এলাকা বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। এই জেলার নাম ঝিনাইদহ “ঝিনুক” এবং “দাহ” শব্দদ্বয় থেকে নেয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়।
️ প্রাচীন ইতিহাস:
ঝিনাইদহ অঞ্চলটি প্রাচীনকাল থেকেই বসবাসযোগ্য এলাকা ছিল। এখানকার বিভিন্ন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রমাণ করে যে এ অঞ্চল সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি প্রাচীন কেন্দ্র ছিল।
বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম শাসকদের শাসনামলে এই অঞ্চল বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মধ্যযুগ ও জমিদার আমল:
-
ঝিনাইদহ অঞ্চলে একসময় বহু জমিদার ছিলেন, যাদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
-
নলডাঙ্গা রাজবাড়ি, মহেশপুর জমিদার বাড়ি, এবং রাখালগাছি রাজবাড়ির মতো স্থাপনা সেই সময়কার সাক্ষ্য বহন করে।
-
ব্রিটিশ আমলে ঝিনাইদহ যশোর জেলার অন্তর্গত ছিল এবং এটি ছিল একটি প্রশাসনিক থানা।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল:
-
ব্রিটিশ শাসনামলে ঝিনাইদহ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষি ও ব্যবসা কেন্দ্র।
-
শিক্ষা, প্রশাসন ও পরিবহন ব্যবস্থায় উন্নতি হয়।
-
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় অনেক হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যায় এবং মুসলিম উদ্বাস্তু এসে এই অঞ্চলে বসতি গড়ে।
️ মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ঝিনাইদহ:
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঝিনাইদহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
-
এখানে বহু সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
-
পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা দুর্দান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
-
জেলার বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন এবং তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক পদক “বীরশ্রেষ্ঠ” লাভ করেন।
️ জেলা হিসেবে স্বীকৃতি:
-
১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে ঝিনাইদহকে একটি পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
-
জেলা হিসেবে গঠনের পর থেকে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড যেমন: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সড়ক, শিল্প উন্নয়ন এবং কৃষিখাতে ব্যাপক অগ্রগতি হয়।
ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি:
-
লোকসংস্কৃতি, পালাগান, যাত্রাপালা, গ্রামীণ মেলা ও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান এই জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ।
-
এখানকার “গাজীর গান”, “বাউল সঙ্গীত” ও “নাটক” বাংলাদেশের লোকঐতিহ্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
✅ ভৌগোলিক সীমানা:
-
উত্তরে: রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়া জেলা
-
দক্ষিণে: যশোর ও মাগুরা জেলা
-
পূর্বে: মাগুরা জেলা
-
পশ্চিমে: চুয়াডাঙ্গা জেলা
✅ প্রশাসনিক এলাকাসমূহ:
ঝিনাইদহ জেলায় মোট ৬টি উপজেলা রয়েছে:
এছাড়া রয়েছে:
-
৬টি পৌরসভা
-
৬৭টি ইউনিয়ন
-
৯৮০টি গ্রাম
✅ জনসংখ্যা:
ঝিনাইদহ জেলার সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী (২০২২), জেলার মোট জনসংখ্যা ২০,০৫,৮৪৯ জন।
জনসংখ্যা বিশ্লেষণ:
- মোট জনসংখ্যা: ২০,০৫,৮৪৯ জন (২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী)
-
পুরুষ: প্রায় ৫০.০৪%
-
নারী: প্রায় ৪৯.৯৬%
-
জনসংখ্যার ঘনত্ব: ১,০২১ জন/বর্গ কিলোমিটার
-
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার: ১.১০% (পুরুষ: ১.০৩%, নারী: ১.১৭%)
-
সাক্ষরতার হার: ৭২.৮১% (পুরুষ: ৭৪.৯৪%, নারী: ৭০.৭২%)+
-
সাক্ষরতার হার (৭ বছর ও তদূর্ধ্ব): ৭২.৮১%
-
ধর্মীয় বিভাজন:
-
মুসলিম: ৯১.৫৫%
-
হিন্দু: ৮.৪০%
-
খ্রিস্টান: ০.০৬%
-
অন্যান্য: ০.০৫%
-
এই তথ্যগুলো ২০২২ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) আদমশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদন থেকে সংগৃহীত।
✅ নদ-নদী:
-
কপোতাক্ষ নদী
-
নবগঙ্গা নদী
-
গড়াই নদী
-
কুমার নদ,
-
ডাকুয়া নদী
-
বেতনা নদী
-
চিত্রা নদী
-
ভৈরব নদী
-
বেগবতী নদী
এই নদীগুলো কৃষি, মৎস্য এবং পরিবহন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
✅ প্রধান ফসল ও ফলমূল:
-
প্রধান ফসল: ধান, পাট, গম, ভুট্টা, আলু, সরিষা
-
ফলমূল: কলা, পেঁপে, কাঁঠাল, লিচু, আম
ঝিনাইদহ বিশেষভাবে কলা ও পেঁপের জন্য বিখ্যাত।
✅ অর্থনৈতিক অবস্থা:
ঝিনাইদহের অর্থনীতি প্রধানত কৃষিনির্ভর। ঝিনাইদহের অর্থনীতি স্বাধারণত কৃষির উপর নির্ভর্শীল। ৬৬.৫০% বাড়িতে নানা ধরনের ফসল ফলিয়ে থাকেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ধান, পাট, আখ, গম, শাকসবজি,মসলা, ডাল। এছাড়াও ফলমুলের মধ্যে রয়েছে আম, পেয়ারা, কাঁঠাল, কলা, লিচু, নারকেল, খেজুর, তাল ইত্যাদি। এছাড়াও অন্যান্য খাত যেমন প্রবাসী, সরকারী চাকুরীজীবী, গার্মেন্টস কর্মীরাও এখানকার অর্থনীতিতে অনেক অবদান রাখছে। তবে:
-
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প রয়েছে
-
হস্তশিল্প এবং তাঁত শিল্প কিছু এলাকায় প্রচলিত
-
বিদেশগামী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স একটি বড় অংশ
-
মাছ ও পশুপালনের ওপর নির্ভরশীল পরিবারও অনেক রয়েছে
✅ দর্শনীয় স্থান ও স্থাপনা:
-
নলডাঙ্গা জমিদার বাড়ি
-
বিশ্ববট, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ
-
সাতগাছিয়া মসজিদ
-
বারবাজারের প্রাচীন মসজিদ
-
বারফা বাওড়
-
গাজীকালু চম্পাবতীর মাজার, বারোবাজার, ঝিনাইদহ
-
শৈলকুপা জমিদার বাড়ি
-
খালিশপুর নীলকুঠি
-
গলাকাটা মসজিদ, বারোবাজার, ঝিনাইদহ
-
জোড় বাংলা মসজিদ
-
পায়রা দূয়াহ্
-
শাহী মসজিদ
-
শিব মন্দির
-
ঢোল সমুদ্রের দীঘি
-
মিয়া বাড়ির দালান
-
পাঞ্জু শাহ’র মাজার
-
কে,পি, বসুর বাড়ী
-
সুইতলা মল্লিকপুরের এশিয়ার বৃহত্তম বট গাছ
-
বলুদেওয়ানের মাজার ( এটি হাসানহাটি গ্রাম বড়োধোপাদি গ্রামের মিলন কেন্দ্রে অবস্থিত)
-
হামিদুর জাদুঘর (খালিশপুর)
✅ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান:
-
ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ
-
শিশু কুঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় এবং কলেজ, ঝিনাইদহ
-
ঝিনাইদহ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যাালয়
-
ঝিনাইদহ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়
-
ঝিনাইদহ কলেজ
-
ঝিনাইদহ সরকারি কে,সি, কলেজ
-
ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ (HSTU এর অন্তর্ভুক্ত)
-
ইদ্রাকপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়
-
ডা. সাইফুল ইসলাম কলেজ,কাটগড়া
-
ঝিনাইদহ পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট
-
ঝিনাইদহ আই. এইচ.টি
-
শেখ কামাল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ঝিনাইদহ
-
শিশুকালি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হরিণাকুণ্ডু, ঝিনাইদহ
-
হাসানহাটি বড় ধোপাদি এবাদৎ আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ,কালিগঞ্জ, ঝিনাইদহ
-
জোড়াদহ বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়
-
সগান্না ছিদ্দিকিয়া দাখিল মাদ্রাসা, ঝিনাইদহ।
-
কাঞ্চন নগর মডেল হাই স্কুল, ঝিনাইদাহ।
-
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
-
তোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়
-
সরকারি লালন শাহ কলেজ, হরিনাকুন্ডু, ঝিনাইদহ
✅ কৃতী ব্যক্তিত্ব:
-
-
লতিফুর রহমান – বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা;
-
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর – আলেম, গবেষক, শিক্ষক, ইসলামিক চিন্তাবিদ, লেখক;
-
গোলাম মোস্তফা – কবি;
-
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান – বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বীরশ্রেষ্ঠ;
-
লালন শাহ – বাউল সাধক, গায়ক, গীতিকার;
-
মুস্তফা মনোয়ার – চিত্রশিল্পী;
-
পাগলা কানাই – সাধক
-
মনির খান – গায়ক;
-
বাঘা যতীন – বিপ্লবী;
-
কে.পি. বসু -গণিতবিদ।
-
জামাল নজরুল ইসলাম– দেশ বরেন্য পৃথিবীর বিখ্যাত গণিতবিদ ও পদার্থ বিজ্ঞানী
-
ইলা মিত্র – তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা
-
মসিউর রহমান – ঝিনাইদহ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
-
ড. রবিউল ইসলাম– প্রখ্যাত রসায়নবিদ। তার লিখিত রসায়ন বই দেশের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সিলেবাসভুক্ত।
-
আল-আমিন হোসেন– বোলার, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল
-