শাইখ তামিম আল আদনানী
ইসলামের দৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদ নিষিদ্ধ কেনো? জাতীয়তাবাদকে (Nationalism) ইসলামের দৃষ্টিতে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ আল-আসাবিয়্যাহ (العصبية) বা জাহেলিয়াতের অপসংস্কৃতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন অনেকে। জাতীয়তাবাদকে ইসলাম বিরোধী একটি কুফরি মতবাদ বা মারাত্মক বিদআত এবং এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন অনেক আলেমেদ্বীন। জাতীয়তাবাদ মূলত ইসলাম দ্বারা নিষিদ্ধ ‘আল-আসাবিয়্যাহ’ (অন্ধ গোত্রপ্রীতি/দলপ্রীতি) এর আধুনিক রূপ।
১. জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা ও ইসলামী
জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা তুলে ধরে বলেন, এটি এমন এক মতবাদ যা একজন মানুষের পরিচয়ের মূল ভিত্তি হিসেবে ইসলামকে নয় বরং ভাষা, ভৌগোলিক অবস্থান, জাতি বা বংশকে স্থাপন করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এই আসাবিয়্যাহকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন:
لَيْسَ مِنَّا مَنْ دَعَا إِلَى عَصَبِيَّةٍ وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ قَاتَلَ عَلَى عَصَبِيَّةٍ وَلَيْسَ مِنَّا مَنْ مَاتَ عَلَى عَصَبِيَّةٍ
“যে ব্যক্তি আসাবিয়্যাহ-র (জাতীয়তাবাদ বা গোত্রপ্রীতির) দিকে আহ্বান করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। যে আসাবিয়্যাহ-র জন্য যুদ্ধ করে, সেও আমাদের দলভুক্ত নয়। আর যে আসাবিয়্যাহ-র উপর মৃত্যুবরণ করে, সেও আমাদের দলভুক্ত নয়।”সুনানে আবি দাউদ, হাদিস নং ৫১২১
২. জাতীয়তাবাদের ভয়াবহ পরিণতি (ইসলামের মূলনীতির সাথে সংঘর্ষ)
শাইখ তামিম আল আদনানী জাতীয়তাবাদ কীভাবে ইসলামের মৌলিক ভিত্তি ও শিক্ষাকে ধ্বংস করে দেয়, তার তিনটি প্রধান দিক তুলে ধরেছেন:
ক. আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা (আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও ঘৃণা) ধ্বংস করে দেয়
ইসলামের একটি মৌলিক আকিদা হলো, আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব স্থাপন করা এবং আল্লাহর জন্যই শত্রুতা পোষণ করা (আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা)। জাতীয়তাবাদ এই নীতিকে নষ্ট করে দেয়।
সংঘর্ষ: জাতীয়তাবাদ একজন মুসলিমকে তার জাতীয়তার ভিত্তিতে একজন অমুসলিমকে ভালোবাসতে শেখায় এবং একই জাতীয়তার ভিত্তিতে একজন মুসলিমকে সমর্থন করতে শেখায়, এমনকি সে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী হলেও।
ফলাফল: এটি মুসলিমদেরকে শুধু পার্থিব স্বার্থের জন্য ভালোবাসা বা ঘৃণা করতে শেখায়, যা ঈমানের মূল শর্তের পরিপন্থী।
খ. মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ববোধ (উখুওয়াহ) ধ্বংস করে দেয় ইসলামে সকল মুসলিম জাতি, ভাষা ও ভৌগোলিক সীমারেখার ঊর্ধ্বে এক দেহের মতো। জাতীয়তাবাদ মুসলমানদের মধ্যে কৃত্রিম সীমানা তৈরি করে তাদের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করে।কুরআনের নির্দেশ: আল্লাহ তাআলা মুসলিমদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে এবং বিভক্ত না হতে নির্দেশ দিয়েছেন।
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ
“আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং বিভক্ত হয়ো না।” আল-কুরআন, সূরা আলে ইমরান (৩): আয়াত ১০৩
হাদীসের উপমা: রাসূল (সা.) মুসলিম উম্মাহকে এক দেহের সাথে তুলনা করেছেন, যেখানে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে একজন মুসলিমের কষ্টে অন্য মুসলিমের অন্তরেও কষ্ট অনুভূত হওয়ার কথা।
تَرَى الْمُؤْمِنِينَ فِي تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ كَمَثَلِ الْجَسَدِ، إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى
“পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা এবং সহানুভূতির ক্ষেত্রে মুমিনদেরকে তুমি একটি দেহের মতো দেখতে পাবে। যখন দেহের কোনো একটি অঙ্গ কষ্ট পায়, তখন অন্য অঙ্গগুলোও জ্বর ও অনিদ্রার মাধ্যমে তার ডাকে সাড়া দেয়।”সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৬০১১
গ. অহংকার ও জাহেলিয়াতের জন্ম দেয়
জাতীয়তাবাদ মানুষকে তার নিজের জাতি, গোত্র বা দেশকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শেখায়। ইসলামে এই ধরনের বংশমর্যাদা বা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের গর্বকে চরম নিন্দনীয় ও জাহেলী যুগের কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।জাতীয়তাবাদের মৃত্যু: জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যুদ্ধ করা বা মৃত্যুবরণ করাকে রাসূল (সা.) জাহেলিয়াতের মৃত্যু বলে আখ্যায়িত করেছেন।
مَنْ قُتِلَ تَحْتَ رَايَةٍ عُمِّيَّةٍ يَدْعُو عَصَبِيَّةً أَوْ يَنْصُرُ عَصَبِيَّةً فَقِتْلَةٌ جَاهِلِيَّةٌ
“যে ব্যক্তি অন্ধ পতাকার নিচে লড়াই করে, যে আসাবিয়্যাহ-র দিকে আহ্বান করে অথবা আসাবিয়্যাহ-কে সাহায্য করে, আর সে অবস্থায় নিহত হয়— তবে তার মৃত্যু জাহেলিয়াতের মৃত্যু।” সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ৪৮৯৬
একমাত্র পরিচয়: মুসলিম
শাইখ তামিম আল আদনানী দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন যে, মুসলিমদের একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত মুসলিম, এবং তাদের আনুগত্য হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য, কোনো সীমানা, পতাকা বা ভাষার জন্য নয়। জাতীয়তাবাদ ইসলামি জীবনব্যবস্থা ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি। তিনি মুসলিমদেরকে এই জাহেলী অপসংস্কৃতি থেকে দূরে থেকে ইসলামের মূল নীতির প্রতি অবিচল থাকার আহ্বান জানান।
জাতীয়তাবাদ (Nationalism) : বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা
জাতীয়তাবাদ (Nationalism) হলো একটি রাজনৈতিক আদর্শ, আন্দোলন, বা মতবাদ যা একটি জাতি (nation)-কে একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মৌলিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে। শাইখ আদনানী তার বক্তৃতায় জাতীয়তাবাদের যে ইসলামি বিশ্লেষণ দিয়েছেন, তার বিপরীতে এর সাধারণ সংজ্ঞা, মূল ধারণা, প্রকারভেদ এবং ইতিবাচক-নেতিবাচক দিকগুলো নিচে বিশ্লেষণ করা হলো:
১. জাতীয়তাবাদের মূল ধারণা
| প্রধান ধারণা | ব্যাখ্যা | ইসলামি দৃষ্টিকোণের সাথে সংঘর্ষ |
| জাতির ধারণা | একটি জাতি হলো এমন একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যাদের মধ্যে সাধারণ ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস, বা ধর্ম-এর মতো কিছু মিল বা বন্ধন কাজ করে। | ইসলামে জাতি/বংশ নয়, বরং ঈমান (বিশ্বাস) হলো ঐক্যের একমাত্র ভিত্তি। |
| স্ব-নির্ধারণের অধিকার | প্রতিটি জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এবং নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নির্ধারণ করার অধিকার রয়েছে। | ইসলামে চূড়ান্ত সার্বভৌমত্ব (হাকিমিয়াত) ও আইন প্রণয়নের অধিকার একমাত্র আল্লাহর। |
| জাতীয় ঐক্য ও স্বার্থ | জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয় এবং রাষ্ট্রের নীতি জাতির সামগ্রিক কল্যাণের দিকে নিবদ্ধ হয়। | মুসলিমের স্বার্থ অবশ্যই উম্মাহর স্বার্থ ও ইসলামি নীতির ঊর্ধ্বে হতে পারে না। |
| সাংস্কৃতিক পরিচয় | একটি সাধারণ সাংস্কৃতিক পরিচয় বা ঐতিহ্যের উপর জোর দেওয়া হয়, যা জাতিটিকে অন্যান্যদের থেকে আলাদা করে তোলে। | মুসলিমের পরিচয় হলো ইসলামি সংস্কৃতি ও শরীয়াহ, যা সকল ভৌগোলিক সংস্কৃতিকে অতিক্রম করে। |
২. জাতীয়তাবাদের প্রকারভেদ
জাতীয়তাবাদের ধরনগুলো এর ভিত্তিতে পার্থক্য তৈরি করে, কিন্তু শাইখের দৃষ্টিতে মৌলিকভাবে উভয় প্রকারই ‘আসাবিয়্যাহ’র আওতাভুক্ত হতে পারে যদি এটি ইসলামি ঐক্যের ঊর্ধ্বে স্থান পায়।
| প্রকারভেদ | ভিত্তি ও মূলনীতি | বিশ্লেষণ |
| নাগরিক জাতীয়তাবাদ (Civic Nationalism) | রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব এবং আইনি নীতির উপর ভিত্তি করে গঠিত। জাতিগত পটভূমির পরিবর্তে সাধারণ রাজনৈতিক আদর্শ এবং মূল্যবোধের প্রতি আনুগত্যের উপর জোর দেয়। (যেমন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) | এটি জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের কথা না বললেও, মুসলিমদের আনুগত্যকে আল্লাহর পরিবর্তে রাষ্ট্রের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। |
| জাতিগত জাতীয়তাবাদ (Ethnic Nationalism) | একটি সাধারণ জাতিগত বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে গঠিত। ভাষা, ধর্ম এবং বংশ এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। (যেমন: জার্মানির প্রারম্ভিক জাতীয়তাবাদ) | এটি সরাসরি আল-আসাবিয়্যাহ-র সাথে সম্পর্কিত, যা বংশমর্যাদা বা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের জন্ম দেয় এবং মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করে। |
৩. জাতীয়তাবাদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব (পর্যালোচনা)
শাইখ আদনানী জাতীয়তাবাদের যে ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন, তা নিম্নলিখিত নেতিবাচক প্রভাবগুলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যদিকে, ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে জাতীয়তাবাদের ‘ইতিবাচক’ দিকগুলোও ইসলামের বৃহত্তর উদ্দেশ্যের পরিপন্থী হতে পারে।
| দিক | প্রভাব | ইসলামি পর্যালোচনা |
| ইতিবাচক | * স্বাধীনতা আন্দোলন: ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন ও নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে অনুপ্রেরণা যোগায়। * ঐক্য ও দেশপ্রেম: একটি জাতির মধ্যে ঐক্য, সংহতি এবং দেশপ্রেম সৃষ্টি করে। * সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ: সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবনে সাহায্য করে। | এই ‘ঐক্য’ ও ‘দেশপ্রেম’ যদি ইসলামি ভ্রাতৃত্বের ঊর্ধ্বে চলে যায় এবং মুসলিমদেরকে বিভক্ত করে, তবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। |
| নেতিবাচক | * অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণা: অন্যান্য জাতির প্রতি অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণা (জেনোফোবিয়া) জন্ম দিতে পারে। * সংঘাত বা যুদ্ধ: অন্যান্য জাতির সাথে সংঘাত বা যুদ্ধ সৃষ্টি করতে পারে। * অভ্যন্তরীণ বৈষম্য: দেশের অভ্যন্তরে জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে। | শাইখ আদনানী এই নেতিবাচক দিকগুলোকেই প্রধান করে তুলে ধরেছেন, যা আল-আসাবিয়্যাহ এবং জাহেলিয়াতের মৃত্যু-এর মাধ্যমে চরম পরিণতি ডেকে আনে। |