শেখ জিল্লুর রহমান
রাষ্ট্রকে ইসলাম থেকে পৃথক করা ঈমান ভঙ্গের কারণ । ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা মানুষের জীবনের প্রতিটি দিককে অন্তর্ভুক্ত করে। তবে, রাষ্ট্র ও রাজনীতির সাথে ইসলামের সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে মুসলিম বিশ্বে দীর্ঘকাল ধরে বিতর্ক বিদ্যমান। এই বিতর্কটি কেবল তাত্ত্বিক নয়, বরং এর প্রায়োগিক দিকও আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর গঠন ও চরিত্রকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। সম্প্রতি, এই বিতর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে, যেখানে দ্বীন ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণকে ‘ঈমান ভঙ্গকারী পাপ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং রাজনীতিকে ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে।
কোরআন ও তাগুতের ধারণা
এই বিতর্কের মূলে রয়েছে সূরা আন-নিসার ৬০ নম্বর আয়াত, যেখানে উল্লেখিত ‘তাগুত’ শব্দটি ‘সীমালঙ্ঘন’ বা ‘সীমা অতিক্রম করা’ থেকে উদ্ভূত। কোরআনে তাগুতকে শয়তান, মূর্তি, প্রতিমা এবং মিথ্যা মতবাদের উপাস্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রূপ হলো সেই ব্যক্তি বা ব্যবস্থা, যা আল্লাহর বিধান পরিবর্তন করে অথবা আল্লাহর আইনের বিপরীতে নিজস্ব আইন দিয়ে বিচার-ফয়সালা করে।
সূরা নিসার ৬০ নম্বর আয়াতটিতে আল্লাহ বলেছেন: “তুমি কি সেই লোকেদের প্রতি লক্ষ্য করনি, যারা তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ কিতাবের এবং তোমার আগে অবতীর্ণ কিতাবের উপর ঈমান এনেছে বলে দাবি করে, কিন্তু তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, অথচ তাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে বহুদূরে নিয়ে যেতে চায়।”
তাফসীর গ্রন্থগুলোতে এই আয়াতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বর্ণিত হয়েছে। যেখানে বিচার ও আইন প্রণয়নের নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর। যে ব্যক্তি বা ব্যবস্থা এই সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে নিজের মনগড়া আইন দ্বারা ফয়সালা করে, সে তাগুতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অনুসারে, তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করা এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের অপরিহার্য শর্ত। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, আল্লাহর আইনের পরিবর্তে মানব-রচিত আইনকে সার্বভৌম হিসেবে গ্রহণকারী যে কোনো রাষ্ট্র বা শাসনব্যবস্থা তাগুতের সংজ্ঞার আওতায় পড়ে। তাই রাষ্ট্র ও ইসলামকে আলাদা করার অর্থ হলো আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে তাগুতের সার্বভৌমত্ব দিয়ে প্রতিস্থাপন করা, যা ঈমান ভঙ্গকারী একটি কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা কাফির।’ (সূরা আল-মায়েদা, আয়াত, ৪৪)। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা যালেম।’ (সূরা আল-মায়েদা, আয়াত, ৪৫)। তিনি আরো বলেন, ‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা ফাসিক।’ (সূরা আল-মায়েদা, আয়াত, ৪৭)
সুতরাং আমরা বলব যে, যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ মনে করে এবং অন্য বিধানকে অধিক উপযোগী ও উপকারী মনে করে তার মাধ্যমে মানুষের বিচার-ফায়সালা করে, তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে কাফির হয়ে যাবে। এদের অন্তর্ভুক্ত ঐ সমস্ত লোক, যারা মানুষের জন্য পথ হিসাবে ইসলাম বিরোধী বিধান রচনা করে। তারা তাদের রচিত বিধানকে মানুষের জন্য অধিক উত্তম ও উপযোগী মনে করেই তৈরি করে থাকে। এ কথা স্বাভাবিকভাবেই জ্ঞাত হওয়া যায় যে, প্রথম পথের চেয়ে দ্বিতীয় পথটি উত্তম মনে করেই মানুষ এক পথ ছেড়ে দিয়ে অন্য পথে চলে।
রাসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শ:একজন রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকা
‘ইসলামে রাজনীতি নেই’ – এমন মন্তব্যকে রাসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী হিসেবে দেখা হয়। কারণ তাঁর জীবন কেবল একজন ধর্মপ্রচারকের জীবন ছিল না, বরং তিনি একই সাথে একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক, সেনাপতি, বিচারপতি ও কূটনীতিক হিসেবেও ভূমিকা পালন করেছেন। মক্কায় দাওয়াত প্রদানকালে তিনি একটি নিপীড়িত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন, কিন্তু মদিনায় হিজরতের পর তিনি একটি নতুন সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি বিচারপতি ও শাসক নিয়োগ করেছেন, বিভিন্ন গোত্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন এবং একটি উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করেছেন। তাঁর এ সকল কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে, রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনা দ্বীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রাসূল (সা.)-এর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে মদিনা সনদকে উল্লেখ করা হয়। এই সনদকে প্রায়শই বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, যেখানে মুসলিম, ইহুদি ও পৌত্তলিক সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল।
ইসলামি ফিকহ ও রাজনৈতিক দর্শনের বিবর্তন
ইসলামের ক্লাসিক্যাল ফিকহশাস্ত্র (আইনশাস্ত্র) রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও শাসনব্যবস্থাকে একটি অপরিহার্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে। মুসলিম উম্মাহর পণ্ডিতগণ এই বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, সমাজে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রাখা মুসলিমদের জন্য একটি সম্মিলিত দায়িত্ব বা ফরয।
আবু আল-হাসান আলী আল-মাওয়ার্দী (৯৭৩-১০৫৮ খ্রি.) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-আহকাম আল-সুলতানিয়া’ (প্রশাসনিক বিধিমালা) তে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও খিলাফতের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ইমামত বা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব হলো নবুয়তের প্রতিনিধিত্ব এবং এর প্রধান কর্তব্য হলো দেশে শরীয়াহ প্রতিষ্ঠা করা।
ইবনে তাইমিয়া তাঁর গ্রন্থ ‘আস-সিয়াসাত আশ-শারিয়াহ’ তে শাসকের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, শাসনের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন ও জনগণের কল্যাণ সাধন করা। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ইসলাম ও রাষ্ট্র একে অপরের উপর নির্ভরশীল; যখন তারা আলাদা হয়, তখন উভয়ই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়।
আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পর্ক
আধুনিক যুগে ইসলাম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে একাধিক মডেল ও দর্শন বিকশিত হয়েছে। পশ্চিমা ধারণা হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা (সেক্যুলারিজম) রাষ্ট্রকে ইসলাম থেকে পৃথক করার নীতি হিসেবে পরিচিত। মুসলিম বিশ্বের অনেক পণ্ডিত এই মতবাদকে ‘ধর্মহীনতা’ এবং ‘ইসলামবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, কারণ এটি (ধর্ম) ইসলামকে ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ করে, যা ইসলামের সর্বজনীনতার ধারণার পরিপন্থী।
আধুনিক ইসলামি চিন্তাবিদদের ভিন্নধর্মী প্রস্তাবনা
‘রাষ্ট্র বনাম ধর্ম’ বিতর্কটি কেবল ‘গ্রহণ’ বা ‘বর্জন’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া যেখানে আধুনিক মুসলিম চিন্তাবিদরা নিজস্ব জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামো ব্যবহার করে পশ্চিমা আধুনিকতার চ্যালেঞ্জগুলোর একটি ইসলামিক সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছেন। এই ধারার উল্লেখযোগ্য কিছু চিন্তাবিদ হলেন ফজলুর রহমান মালিক, আব্দুল্লাহি আহমেদ আন-নাইম, এবং মোহাম্মদ আরকুন।
প্রদত্ত বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে, ইসলামকে রাষ্ট্র থেকে পৃথকীকরণের ধারণাটি ধর্মতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য। কোরআন, সুন্নাহ এবং ক্লাসিক্যাল ফিকহ শাস্ত্রের একটি বড় অংশই রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে দ্বীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখে। রাসূল (সা.)-এর রাজনৈতিক জীবন এবং ফিকহবিদদের আলোচনা এই ধারণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে যে, রাষ্ট্র ছাড়া ইসলামী আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবে, এই আদর্শের বাস্তব প্রয়োগ অত্যন্ত জটিল এবং আধুনিক বিশ্বে এর সংগতি বিধান করা একটি চলমান চ্যালেঞ্জ।