ডা. জেড এম সুলতানুল আরেফিন
ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতাই মূল প্রতিকার। এমবিবিএস (রাজ), সিএমইউ (আল্ট্রা), মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, মেডিসিনে অভিজ্ঞ ও সোনোলজিস্ট। বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন শুধুমাত্র একটি মৌসুমি সমস্যা নয়, বরং একটি নিয়মিত জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়েছে। বর্ষা মৌসুম এলেই শহর ও গ্রাম উভয় এলাকায় ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপকহারে। চলতি বছর ২০২৫ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন এবং অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন। স্বাস্থ্যখাতের জন্য এটি একটি গুরুতর সংকেত। সচেতনতা, সঠিক পরীক্ষা, যথাযথ চিকিৎসা এবং মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।
ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা মূলত এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিকটাস নামক দুই প্রকার মশার মাধ্যমে ছড়ায়। মশাগুলি সাধারণত ভোর ও সন্ধ্যাবেলা কামড়ায় এবং পরিষ্কার জমে থাকা পানিতে প্রজনন করে। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি প্রধান সেরোটাইপ রয়েছে: ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ এবং ডেন-৪। একজন ব্যক্তি একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন এবং দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার সংক্রমণ অনেক সময় বেশি মারাত্মক রূপ ধারণ করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৩ সালের নির্দেশিকা অনুযায়ী ডেঙ্গু জ্বরকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। সাধারণ ডেঙ্গুর লক্ষণ হিসেবে দেখা যায় হঠাৎ উচ্চমাত্রার জ্বর (১০২°F থেকে ১০৫°F পর্যন্ত), মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, পেশি ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, বমি বা বমির ভাব, ত্বকে লালচে র্যাশ, ক্লান্তি ও দুর্বলতা। সতর্ক সংকেতযুক্ত ডেঙ্গুতে থাকে তীব্র ও ক্রমাগত পেটব্যথা, বারবার বমি হওয়া, অস্বাভাবিক রক্তপাত (নাক, মুখ, মাড়ি বা প্রস্রাবে), অস্থিরতা ও ঘন ঘন ঘুম আসা, চামড়ার নিচে নীল দাগ, প্লেটলেট গণনার দ্রুত হ্রাস এবং হেমাটোক্রিট বৃদ্ধির সঙ্গে শরীরের পানিশূন্যতা। গুরুতর ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে দেখা যায় ডেঙ্গু হেমোরাজিক ফিভার বা শক সিনড্রোম, রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুস বা পেটের মধ্যে পানি জমা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা স্নায়বিক জটিলতা এবং লিভার, কিডনি, হৃদপিণ্ড বা মস্তিষ্কে জটিলতা দেখা দিলে মৃত্যুঝুঁকি থাকে।
ডেঙ্গু শনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। CBC (Complete Blood Count) দ্বারা প্লেটলেট সংখ্যা, সাদা রক্তকণিকা ও হেমাটোক্রিট পরিমাপ করা হয়। NS1 Antigen Test জ্বরের প্রথম ১ থেকে ৫ দিনের মধ্যে করে ভাইরাস শনাক্ত করা যায়। IgM ও IgG Antibody Test এর মাধ্যমে সংক্রমণের বর্তমান ও পুরাতন অবস্থা নির্ধারণ করা যায়। LFT (Liver Function Test) দ্বারা SGPT ও SGOT এর মাধ্যমে লিভারের অবস্থা বোঝা যায়। RFT (Renal Function Test) কিডনির কার্যকারিতা যাচাই করে। Electrolytes Test এর মাধ্যমে সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্লোরাইডের ঘাটতি নির্ণয় করা যায়। D-dimer এবং Coagulation Profile (PT, aPTT) রক্তপাতের ঝুঁকি নির্ধারণে সহায়ক। Chest X-ray ও Abdominal Ultrasonography অভ্যন্তরীণ ফ্লুইড লিকেজ শনাক্তে সহায়তা করে। CRP ও ESR ইনফ্ল্যামেশন ও সংক্রমণের মাত্রা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ।
ডেঙ্গুতে নির্দিষ্ট কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর ক্লিনিক্যাল অবস্থার ওপর। সাধারণ ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে ঘরে থেকেই পর্যাপ্ত বিশ্রাম, প্রচুর তরল পান, প্যারাসিটামল সেবন এবং প্লেটলেট পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে চিকিৎসা সম্ভব। সতর্ক সংকেতযুক্ত ডেঙ্গু রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করে নিয়ন্ত্রিতভাবে ইনট্রাভেনাস স্যালাইন, সিরিয়াল CBC, LFT, RFT পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনে প্লেটলেট ট্রান্সফিউশন, রক্তক্ষরণ হলে ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা বা হোল ব্লাড প্রয়োগ এবং ICU সাপোর্ট প্রয়োজন হতে পারে। গুরুতর ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে অবিলম্বে আইসিইউ তে ভর্তি করে জীবন রক্ষাকারী তরল ওষুধ, ভেন্টিলেশন সাপোর্ট, কার্ডিয়াক মনিটরিং এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা দিতে হয়।
বাড়িতে চিকিৎসার সময় রোগীর প্রস্রাবের পরিমাণ নজরদারি করা, অচেতনতা বা অতিরিক্ত দুর্বলতা দেখা দিলে বিলম্ব না করে হাসপাতালে যাওয়া, মশারি ব্যবহার করা।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো জনসচেতনতা। ঘরের ভেতর ও বাইরে জমে থাকা পানি ফেলে দিতে হবে। পানির ড্রাম, ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার ও কনটেইনার নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে জনগণকে সচেতন করতে হবে।
ডেঙ্গু এখন আর শুধুই একটি মৌসুমি জ্বর নয়। এটি একটি ঘাতক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে, যা সময়মতো সনাক্ত ও চিকিৎসা না করালে প্রাণহানির ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। প্রতিটি মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, স্থানীয় প্রশাসন এবং সাধারণ জনগণ—সকলের সম্মিলিত উদ্যোগেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব। সঠিক জ্ঞান, সঠিক পদক্ষেপ এবং মানবিক দায়িত্ববোধ থাকলেই ডেঙ্গুকে আমরা জয় করতে পারব।