মাও. ওয়ালিউল্লাহ
কোরবানি কবুল হওয়ার সাত শর্ত। কোরবানি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যুগে যুগে সমস্ত উম্মতের ওপর কোরবানি করার বিধান ছিল। তবে আমাদের ওপর যে কোরবানি ওয়াজিব, তা জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নাত। এই কোরবানি আল্লাহতায়ালার নিকট কবুল হওয়ার জন্য কিছু শর্তের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। এমন কয়েকটি শর্ত নিম্নরূপ-
১. বিশুদ্ধ নিয়ত: কোরবানির অন্যতম প্রধান শর্ত হলো বিশুদ্ধ নিয়ত। মুসলমানদের কোরবানি কেবল আল্লাহর সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করতে হবে। নিয়ত হলো কাজের আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ, যা কোরবানির পূর্ণতার জন্য অপরিহার্য।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এগুলোর (কোরবানির পশুর) গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। কিন্তু পৌঁছে তাঁর নিকট তোমাদের মনের তাকওয়া।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৭)
সুতরাং লোক দেখানো মনোভাব, গোশত খাওয়া, নিজের আভিজাত্যের প্রকাশ প্রভৃতি নিয়তে কোরবানি বৈধ হবে না।
২. হারাম পরিহার: কোরবানি করতে হবে হালাল সম্পদ থেকে। হারাম মিশ্রিত সম্পদের বিনিময়ে ক্রয়কৃত পশুর কোরবানি আল্লাহর নিকট কবুল হবে না। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা পবিত্র। তিনি কেবল পবিত্র জিনিসই কবুল করেন।’ (মুসলিম, ২৩৯৩)
কোরবানিতে শরিক নেওয়ার ক্ষেত্রেও তাই সতর্ক থাকতে হবে। যদি কারও ব্যাপারে নিশ্চিত জানা যায় যে, সে হারাম সম্পদ থেকে কোরবানি করছে, তা হলে এমন ব্যক্তির সঙ্গে এক পশুতে কোরবানি করা যাবে না। শরিয়তের দৃষ্টিতে এমন লোকের কোরবানি এবং তার সঙ্গে অন্য শরিকদের কোরবানিও কবুল হবে না।
৩. পশুর প্রকার: কোরবানির পশু হতে হবে ‘বাহিমাতুল আনআম’ অর্থাৎ গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি নির্ধারণ করেছি, যেন তারা আল্লাহর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৪)
চতুষ্পদ জন্তুর অন্তর্ভুক্ত হলো উট, গরু, মহিষ, বকরি, ভেড়া ও দুম্বা। এগুলো ব্যতীত অন্য কোনো প্রকার পশু দ্বারা কোরবানি বৈধ হবে না। (কাজিখান: ৩/৩৪৮)
৪. পশুর বয়স: কোরবানি বৈধ হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট বয়সের পশু জবাই করা আবশ্যক। হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা মুসিন্না (৫ বছর বয়সী উট, ২ বছর বয়সী গরু এবং ১ বছর বয়সী বকরি) ব্যতীত জবাই করো না। যদি তা সম্ভব না হয় তা হলে ৬ মাস বয়সী ভেড়া বা দুম্বা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৬৩) সুতরাং উটের বয়স কমপক্ষে পাঁচ বছর, গরু ও মহিষের বয়স দুই বছর, বকরি, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে এক বছর বয়সী হতে হবে। তবে ছয় মাসের ভেড়া ও দুম্বা যদি এতটা হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে এক বছর বয়সী মনে হয়, তা হলে এমন ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। তবে বকরি যতই হৃষ্টপুষ্ট হোক, তা এক বছর বয়সী হওয়া বাধ্যতামূলক। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৫)
৫. পশুর স্বাস্থ্য: কোরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট হওয়া উত্তম। (মুসনাদে আহমাদ: ৬/১২৩) কোরবানির পশুতে তাই এমন কোনো ত্রুটি থাকা চলবে না, যা তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে বা তার মূল্য ও গুণগতমান কমিয়ে দেয়। সুতরাং পশুটি যেন অন্ধ বা একচোখা না হয়, স্পষ্ট কোনো রোগে আক্রান্ত না হয়, এমন পঙ্গু না হয় যে হাঁটতে অক্ষম, কিংবা এতটাই দুর্বল না হয় যে তার শরীরে মজ্জা থাকে না, অর্ধেকের বেশি যেন লেজ ও কান কাটা না হয়, মুখের অধিকাংশ দাঁত যেন অবশিষ্ট থাকে, শিং যেন গোঁড়া থেকে ভেঙে না যায় (তবে জন্মগতভাবে শিং না উঠলে সমস্যা নেই)। এসব শর্ত ঠিকঠাক আছে এমন পশু দ্বারাই কেবল কোরবানি করা বৈধ। (জামে তিরমিজি, ১৪৯৭)
৬. কোরবানির সময়: নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোরবানি করা আবশ্যক। কোরবানির সময় শুরু হয় ঈদুল আজহার নামাজের পর থেকে এবং তা অবশিষ্ট থাকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। (হিন্দিয়া: ৫/২৯৫) এর আগে বা পরে কোরবানির পশু জবাই করলে তা দ্বারা কোরবানি আদায় হবে না।
হজরত বারা ইবনে আজেব (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ঈদের দিন আমরা প্রথমে নামাজ আদায় করব, অতঃপর ফিরে এসে কোরবানি করব। যে ব্যক্তি এভাবে আদায় করবে, সে আমাদের নিয়মমতো করল। আর যে নামাজের আগেই জবাই করল, এটা তার পরিবারের জন্য গোশত হবে। কোরবানি হবে না। (বুখারি, ৯৬৫)
৭. কোরবানির পদ্ধতি: কোরবানির পশু অবশ্যই ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী জবাই করতে হবে। জবাইকারীর মুসলমান হওয়া এবং আল্লাহর নামে জবাই করা আবশ্যক। এ ছাড়া ব্যবহৃত ছুরি বা যন্ত্রপাতি ধারালো হতে হবে, যাতে পশুর কষ্ট কম হয়। কোরবানির পশু নিজ হাতে জবাই করা উত্তম। তবে অন্যকে দিয়েও জবাই করাতে পারবে। এক্ষেত্রে কোরবানিদাতা পুরুষ হলে জবাইয়ের সময় সেখানে উপস্থিত থাকা উত্তম। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২২৬৫৭)