আধুনিক বাংলা কবিতার বিশ্বাসী কণ্ঠ—আল মাহমুদের ৯০তম জন্মবার্ষিকী আজ

সাইম সাইদি  বিশেষ প্রতিনিধিঃ

আধুনিক বাংলা কবিতার বিশ্বাসী কণ্ঠ—আল মাহমুদের ৯০তম জন্মবার্ষিকী আজ। আজ ১১ জুলাই, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, কবি আল মাহমুদের ৯০তম জন্মবার্ষিকী। তাঁর কবিতা, রাজনৈতিক দর্শন এবং সাহিত্যচর্চা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে দিয়েছে নতুন দিগন্ত, নতুন ভাষা। শুধু কবিতায় নয়, আল মাহমুদ ছিলেন সময়ের এক সাহসী ভাষ্যকার, এক ব্যতিক্রমী যোদ্ধা, যার কলমে ফুটে উঠেছিলো প্রেম, মাটি, ধর্ম ও রাষ্ট্রচিন্তার সম্মিলিত ছাপ।

আল মাহমুদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে, এক সাধারণ মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে। প্রকৃত নাম ছিল মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ। শৈশব কেটেছে গ্রামীণ প্রকৃতির ছায়াঘেরা পরিবেশে, যা পরবর্তীতে তাঁর কবিতার ভাষা ও মননে প্রভাব ফেলেছিল গভীরভাবে।

আল মাহমুদের সাহিত্যিক যাত্রা শুরু হয় সাংবাদিকতা দিয়ে। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকায় এসে দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফরিডার হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে ‘সাপ্তাহিক কাফেলা’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। এরপর ‘কালের কলস’, সোনালি কাবিন মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ সহ অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ তাঁকে বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।

তাঁর কবিতায় ছিলো ধর্মীয় অনুভূতি, গ্রামীণ ভাষা ও লোকজ উপমার গভীর প্রয়োগ। প্রেম, প্রতিবাদ, ইতিহাস, বিশ্বাস ও আত্মপরিচয়ের জটিল সংমিশ্রণে তিনি বাংলা কবিতায় প্রতিষ্ঠা করেন এক স্বকীয় সত্তা।

আল মাহমুদের রাজনৈতিক চিন্তা সময়ের প্রবাহে নানা বাঁক নিয়েছে। ষাটের দশকে তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। তিনি ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করলেও পরবর্তীকালে বাংলা মুসলিম সমাজের আত্মপরিচয়, ইসলামি সংস্কৃতি এবং আরব-ফারসি ঐতিহ্যের প্রতি তার ঝোঁক প্রকাশ পেয়েছে স্পষ্টভাবে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী সরকারের অধীনে তথ্য বিভাগে কাজ করেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করেন। তবে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ক্রমেই বিতর্কিত হয়ে ওঠে।

১৯৭৩ সালে গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক থাকা অবস্থায় তাঁর কিছু লেখা তৎকালীন সরকারের বিরোধিতা করায় তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
এ ঘটনার পর থেকেই আল মাহমুদ সক্রিয়ভাবে রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি নিয়ে লেখা-লিখিতে মনোনিবেশ করেন।

পরবর্তীকালে তাঁর লেখায় ইসলামি ভাবধারা প্রবল হয়ে ওঠে। আশির দশক থেকে তিনি ধীরে ধীরে ইসলামি আদর্শ ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সমর্থক হিসেবে পরিচিতি পান।
এ কারণেই অনেক প্রগতিশীল ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য গড়ে ওঠে।

তাঁর লেখা উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং কবিতায় ইসলামি আদর্শ, ধর্মীয় বিশ্বাস, নৈতিকতা এবং মুসলিম পরিচয়ের প্রতি একটি অবিচল অনুরাগ লক্ষ্য করা যায়। এ কারণে অনেকে তাঁকে বিশ্বাসীদের কবি বলেও অভিহিত করেছেন।

সত্তরের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে সহকারী পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৯৩ সালে এই পদ থেকেই অবসর গ্রহণ করেন।

সাহিত্যিক পরিচয়ের পাশাপাশি তিনি একজন সংস্কৃতিকর্মী, সম্পাদক এবং চিন্তাবিদ হিসেবেও ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ।

আল মাহমুদের সাহিত্য শুধু কবিতায় সীমাবদ্ধ নয়। তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধসহ বহু শাখায় তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রন্থ:

উপন্যাস: কবি ও কোলাহল, উপমহাদেশ, আরব্য রজনীর রাজহাঁস

গল্প: পানকৌড়ির রক্ত, দ্বিতীয় ভাঙন

প্রবন্ধ: বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, কবিতার ভূগোল

শিশুসাহিত্য: শিশুদের আল মাহমুদ

আল মাহমুদ ছিলেন একজন সত্যনিষ্ঠ কবি, যিনি জীবন ও সময়ের বাস্তবতাকে কাব্যে রূপ দিয়েছেন বিশ্বাসের আলোয়। তাঁর কবিতা শুধু প্রেম বা প্রকৃতি নয় একটি জাতির আত্মপরিচয়ের খোঁজ। তিনি যে দ্বন্দ্ব, বিতর্ক ও প্রশ্নের মধ্য দিয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, সেটিই তাঁকে একজন জীবন্ত ও সাহসী সাহিত্যিক করে তোলে।

আজ তাঁর ৯০তম জন্মবার্ষিকীতে আমরা শ্রদ্ধা জানাই এই অগ্রগামী কবিকে, যিনি একাধারে ছিলেন শব্দযোদ্ধা, চিন্তাশীল প্রতিবাদী এবং বিশ্বাসীদের সাহসী কণ্ঠস্বর।

Scroll to Top