শেখ জিল্লুর রহমান
নলডাঙ্গায় রাজা ভূষণদের শাসন ও অবদান সম্পর্কে বলতে গেলে কালীগঞ্জ উপজেলার অনেক অবকাঠামোর কথা উল্লেখ করতে হয়। নলডাঙ্গা রাজবংশের রাজা ভূষণদের কালীগঞ্জ অঞ্চলে প্রভাবশালী ভূমিকা ছিল। তাঁদের শাসনামলে এই অঞ্চলে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে রাজার ভুমিকা অপরিসীম।
-
রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় (১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ): তিনি নলডাঙ্গা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত। তিনি ৭টি মন্দির নির্মাণ করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মন্দির, কালীমাতা মন্দির, লক্ষ্মী মন্দির, তারা মন্দির এবং দ্বিতল বিশিষ্ট বিঞ্চু মন্দির।
-
রাজা প্রমথ ভূষণ রায় বাহাদুর: তিনি রাজবাড়ি স্থানান্তর করে গুঞ্জানগরে একটি সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণ করেন এবং সেখানে চিড়িয়াখানা, দেব-দেবীর মন্দির এবং নাটমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অবদান
রাজা ভূষণদের শাসনামলে নির্মিত মন্দিরগুলো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এই মন্দিরগুলো এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং স্থানীয় জনগণের ধর্মীয় চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন
রাজা ভূষণদের শাসনামলে কালীগঞ্জ অঞ্চলে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়, যা এখনও এই অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে।। ব্রিটিশ আমলে এখানে নদীর উপর ব্রিজ এবং রেল স্টেশন নির্মিত হয়, যা এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করে।
বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে নলডাঙ্গা রাজবাড়ির মূল প্রাসাদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও মন্দিরগুলো এখনও টিকে আছে। স্থানীয় উদ্যোগে তৈলকুপ গ্রামে নলডাঙ্গা রাজবাড়ি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন বিনোদনমূলক সুবিধা রয়েছে।
প্রশাসনিক কর্মকর্তা
পূর্ববর্তী রাজাদের প্রশাসনিক কাঠামো সম্পর্কে জানা না গেলেও শেষ রাজা শশী ভূষণ দেবরায়ের শাসনামলে নলডাঙ্গা রাজবাড়িতে নিযুক্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য বর্তমানে সহজলভ্য নয়। তবে, জমির উদ্দিন শেখ সম্পর্কে ইতিহাস সাক্ষ্যদেয় যিনি রাজার দেওয়ানী হিসেবে কাজ করতেন। তার বড় পুত্র ইবাদত শেখ তেলকুব গ্রামে বসবাস করতেন। ইবাদ শেখের বড়পুত্র আব্দুল মুজিদ শেখ প্রথমে তেলকুব পরবর্তীতে নলডাঙ্গাগ্রামে বসবাস করতেন। তার তিনপুত্র শহিদুল শেখ, শেখ জিল্লুর রহমান ও আব্দুল কবির শেখ। এছাড়াও ইবাদত শেখের আরো দুই পুত্র ছিলেন দুলাল শেখ ও আজিবর শেখের বংশধররা বর্তমানে তেলকুব গ্রামে বসবাস করছেন। এছাড়া উল্লেখ্য যোগ্য তেমন তথ্য পাওয়া যায় না তবে, ঐ সময়ে জমিদার বা রাজবাড়িতে সাধারণত নিম্নলিখিত ধরনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নিয়োজিত থাকতেন:
-
দেওয়ান: আর্থিক ও প্রশাসনিক বিষয়াদি তদারকি করতেন।
-
মুনশি: দলিলপত্র রক্ষণাবেক্ষণ ও চিঠিপত্রের খসড়া প্রস্তুত করতেন।
-
তহসিলদার: ভূমি রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকতেন।
নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী
-
গোমস্তা: রাজস্ব সংগ্রহ ও প্রজাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
-
চৌকিদার ও দারোয়ান: রাজবাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেন।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা
-
পুরোহিত: মন্দিরের পূজা-অর্চনা পরিচালনা করতেন।
-
নাট্যশালা ও সঙ্গীতশালার পরিচালক: সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাট্য পরিবেশনার দায়িত্বে থাকতেন।
অন্যান্য কর্মচারী
-
রান্নার বাবুর্চি, পরিচারক ও পরিচারিকা: দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজ পরিচালনা করতেন।
-
ঘোড়সওয়ার ও পালকি বাহক: রাজপরিবারের যাতায়াতের ব্যবস্থা করতেন।
এই ধরনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা রাজা শশী ভূষণ দেবরায়ের শাসনামলে রাজবাড়ির কার্যক্রম পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।
নলডাঙ্গা রাজবংশের ভূষণ পরিবার ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় শিক্ষাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ আজও ঐ অঞ্চলের শিক্ষার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
নলডাঙ্গা ভূষণ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়
১৮৬৯ সালে রাজা ইন্দু ভূষণ দেবরায় নলডাঙ্গা রাজবাড়িতে “মিডল ইংলিশ স্কুল” নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে, ১৮৮২ সালে রাজা বাহাদুর প্রমথ ভূষণ দেবরায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি “ইংলিশ হাই স্কুল” হিসেবে উন্নীত হয়। বিদ্যালয়টি ১৯০৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯১৫ সালে ঢাকার বিভাগীয় পরিদর্শক খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেন এবং মুসলিম শিক্ষার্থী ও শিক্ষক না থাকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। বর্তমানে এটি “সরকারি নলডাঙ্গা ভূষণ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়” নামে পরিচিত এবং ২০২৫ সালে জাতীয়করণ করা হয়েছে ।
নলডাঙ্গা ভূষণ শিশু একাডেমী
১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত নলডাঙ্গা ভূষণ শিশু একাডেমী ঝিনাইদহ জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করে আসছে ।
ভূষণ পরিবারের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কালীগঞ্জ অঞ্চলের শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক