হিটলারের অহংকার চূর্ণ করা এক ‘বুলেট’ নজেসি ওয়েন্স

হিটলারের অহংকার চূর্ণ করা এক ‘বুলেট’ নজেসি ওয়েন্স

ঝিনেদার কাগজ ডেস্ক

হিটলারের অহংকার চূর্ণ করা এক ‘বুলেট’ নজেসি ওয়েন্স। ২০১২। স্টুয়ার্ট ওয়েন র‌্যানকিন একটা কাজে গিয়েছেন জার্মানিতে। কাজ-টাজ শেষে সহকর্মীদের সঙ্গে বের হলেন একটু উদ্‌যাপন করতে। ইউরো চলছিল। কোয়ার্টার ফাইনালে গ্রিসকে ৪-২ গোলে হারিয়ে জার্মানদের ইউরো-উৎসব চাঙা রেখেছেন ওজিল-লামরা। মুখে জার্মান পতাকা এঁকে রাতের পার্টিতে মজতে মজতে ৪৫ বছর বয়সী মানুষটি হুট করে একটা ধাক্কা খেলেন।

‘কী অদ্ভুত, একেবারে স্যুরিয়াল! জার্মানিতে বসে, আমি জার্মান দলের পক্ষে গলা ফাটাই। কী অদ্ভুত, যেন চক্রপূরণ!’

র‌্যানকিন তাঁর নানার পরিচয় কোথাও জাহির করেন না। কিন্তু সেদিন সম্ভবত মনের মধ্যে ওই উপলব্ধিটুকুর জন্যই বলে ফেললেন।

সবার চোখে অবিশ্বাস। আমার অবশ্য সয়ে গেছে। ওরা জানতে চাইল, ‘লুজ লংকে চেনো? আমি বললাম, অবশ্যই।’

আড্ডার মধ্যে একটি মেয়ে মুঠোফোনের কন্ট্যাক্ট থেকে জুলিয়া লুইজি লংকে খুঁজে বের করে বলল, ‘আমি লুজ লংয়ের নাতির বন্ধু।’তারপর কী ঘটেছে, সেটা জানা গেল গত বছর সিএনএনে র‌্যানকিনের জবানিতে। জুলিয়া লংয়ের সঙ্গে ডিনারে গিয়েছিলেন র‌্যানকিন। তাঁর ভাষায়, ‘খুব বিশেষ একটা মুহূর্ত। বিশেষ কিছু কথাবার্তাও হয়। অলিম্পিয়ানের নাতি হতে কেমন লাগে, তা নিয়ে কথা বলেছি।’

র‌্যানকিন নিশ্চয়ই সেদিন টের পেয়েছিলেন, চোখের সামনে অলিম্পিকের একখণ্ড ‘ক্ল্যাসিক’ ইতিহাসের চক্রপূরণ হতে দেখতে কেমন লাগে!

র‌্যানকিনের নানা জেসি ওয়েন্স।

জুলিয়ার দাদা লুজ লং।

দুজনই অলিম্পিক কিংবদন্তি। ১৯৩৬ বার্লিন অলিম্পিকে প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে বন্ধু।

অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি রাজনীতির পাঠে নিগ্রো রক্তের সঙ্গে আর্য রক্তের ধারক জার্মানদের বন্ধুত্ব ভালো চোখে দেখা হয়নি। লুজকে সে জন্য অনেক কিছুই সইতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেসব যন্ত্রণা-টন্ত্রণা থেকে লুজ চিরমুক্তি নিয়ে নেওয়ার পর গল্পটা আর এগোয়নি।

সেই সাক্ষাতে র‌্যানকিন ও জুলিয়ার মনে তাই রোমাঞ্চ না জেগে পারে না। তাঁরা-ই তো ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ! আড্ডায়-আলাপে নিশ্চয়ই তাঁদের মন খুঁজে নিয়েছিল অদেখা সেই বার্লিন অলিম্পিকে। অলিম্পিয়াস্তাদিওনে সাদা-কালো সেই সময়ে আশপাশে ছোট-বড় স্বস্তিকা চিহ্ন, গ্যালারিতে উঁচু আসনে অ্যাডলফ হিটলার, চারপাশে নাৎসিজমের প্রচার আর মাঠে ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রসববেদনায় কাতর ইতিহাস।

সেই ইতিহাসের জন্মেই তো হিটলারের জাতিগত অহম রাইনের বুকে টুকরা টুকরা বরফ খণ্ডের মতো ভেঙে খান খান হলো!

সোনাঝরা দিনে দর্পচূর্ণ
১৯৩৩ সাল। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে দুটি ঘটনা ঘটল। তিন বছর পর সে দুটি ঘটনার পথরেখা এসে মিলল অলিম্পিয়াস্তাদিওনে।

সে বছর শিকাগোয় ন্যাশনাল হাইস্কুল চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ গজ (৯১ মিটার) দৌড় ৯.৪ সেকেন্ডে শেষ করে বিশ্ব রেকর্ড ছুঁল ওয়েন্স। ২২০ গজ (২০১ মিটার) দৌড়ে ভাঙল ন্যাশনাল হাইস্কুল (২০.৭ সেকেন্ড) রেকর্ড আর লং জাম্পে পাড়ি দিল ২৪ ফুট ৯.৫ ইঞ্চি। সে বছরই জার্মানির চ্যান্সেলর হলেন হিটলার।

জার্মানরা যে জাতিগতভাবে শ্রেষ্ঠ, তা বিশ্বের সামনে প্রমাণে তিন বছর পর বার্লিন অলিম্পিক হলো হিটলারের লক্ষ্যবস্তু। নাৎসিজমের একটা ডিসপ্লেও বিশ্বকে দেখানোর মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হলো। অতীতে আর কোনো অলিম্পিক গেমস টিভিতে বিশ্বব্যাপী প্রচার করা হয়নি। ১৯৩৬ বার্লিনই টিভিতে বিশ্বব্যাপী প্রচার পাওয়া প্রথম অলিম্পিক।

আমি হিটলারের সঙ্গে করমর্দন করতে বার্লিন অলিম্পিকে যাইনি। দৌড়াতে গিয়েছিলাম এবং সেটাই করেছি।
জেসি ওয়েন্স
জার্মানদের জাতিগতভাবে শ্রেষ্ঠ প্রমাণে মরিয়া হিটলারের জার্মানি দল থেকে ইহুদি ক্রীড়াবিদেরা বাদ পড়লেন। নাৎসিদের চেতিয়ে তোলা হবে, এই ভয়ে কিছু দেশ ইহুদি ক্রীড়াবিদদের বহরে রাখল না। নাৎসিবাদের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় বহিষ্কৃত হলো লিথুয়ানিয়া। যুক্তরাষ্ট্রে প্রশ্ন উঠল, হিটলারের গেমসে অংশ নেওয়া ঠিক না বেঠিক? সেখানে কৃঞ্চাঙ্গদের সংগঠন এনএএসিপির সচিব ওয়াল্টার ফ্রান্সিস হোয়াইট বার্লিন অলিম্পিকে অংশ না নিতে ওয়েন্সকে খুব করে বোঝালেন। আমেরিকান অলিম্পিক কমিটির প্রধান আভেরি ব্রান্ডেজ ঘোষণা করলেন, গেমস রাজনীতি নয়, অ্যাথলেটদের জায়গা। ওয়েন্সের জায়গা থেকে দেখলে, বার্লিন গেমস নিয়ে চারপাশে যা শুনছিলেন, সেই অভিজ্ঞতাগুলো তাঁর জন্য নতুন না।

শুধু গায়ের রংটা যে মানুষের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাকের কারণ, ওয়েন্সকে সেটা অল্প বয়সেই বুঝতে হয়েছিল। ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে তৃতীয় বর্ষে অলিম্পিক দলে সুযোগ পেলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের প্রিমিয়ার অ্যাথলেট হয়েও স্কলারশিপ পাননি। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পেয়েছেন সেই নামটি ‘দ্য বাকায় বুলেট।’ পড়াশোনার খরচ জোগাতে কী করেননি! যুক্তরাষ্ট্রের একজন কৃঞ্চাঙ্গ নাগরিক হিসেবে তাঁর সিভিতে যেন কর্মদক্ষতার কমতি ছিল না; গ্যাস পাম্প, লিফট অপারেটর, টেবিলের ওয়েটার! বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড দলের অধিনায়ক, তবে (প্রথম) কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার জন্যই সম্ভবত ক্যাম্পাসে থাকার সুযোগ পাননি। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে শ্বেতাঙ্গ সতীর্থরা যেসব রেস্টুরেন্টে খেতে যেতেন, তাঁর সেসব জায়গায় অনুমতি ছিল না।

ওয়েন্স বার্লিনে গেলেন।

কেন গিয়েছিলেন, আর হিটলার তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন কি না—এ দুটি প্রশ্নের উত্তর একসঙ্গে পাওয়া যায় অনেক পরে ওয়েন্সের বলে যাওয়া একটি কথায়। ২০১৬ সালে ‘বিল্ড’কে বলেছিলেন তাঁর মেয়ে মার্লিন ওয়েনস র‌্যানকিন, ‘তিনি সব সময় বলতেন, “আমি হিটলারের সঙ্গে করমর্দন করতে বার্লিন অলিম্পিকে যাইনি। দৌড়াতে গিয়েছিলাম এবং সেটাই করেছি।”’ এসএস ম্যানহাটান জাহাজে চেপে যুক্তরাষ্ট্র অলিম্পিক দল জার্মানিতে পৌঁছাল।
অলিম্পিক ভিলেজে ওয়েন্সের সঙ্গে দেখা হলো অ্যাডিডাসের প্রতিষ্ঠাতা এডি ড্যাসলারের। হুট করে সাক্ষাৎ নয়, ড্যাসলার রথ দেখার সঙ্গে কলাও বেচলেন; ওয়েন্স তাদের জুতা পরতে রাজি হন। কোনো আফ্রিকান-আমেরিকান অ্যাথলেটের সেটাই প্রথম স্পনসর। দুই মাস আগে শিকাগোয় ১০০ মিটার দৌড়ে (১০.২) বিশ্ব রেকর্ড গড়ে বার্লিনে পা রেখেছিলেন ওয়েন্স। হিটে দুবার ‘টেইলউইন্ড’ নিয়ে সেটা ছুঁলেন। ৩ আগস্ট পদক জয়ের লড়াইয়ে একটু বাড়ল; ১০.৩ সেকেন্ডে সোনা জয়।

পরের দিন, লং জাম্পে ২৬ ফুট ৫ ইঞ্চি পাড়ি দিয়ে জিতলেন সোনা। নিজের গড়া বিশ্ব রেকর্ড থেকে ৩ ইঞ্চির একটু বেশি পিছিয়ে থেকে সেই জয়ে ওয়েন্স আরও বড় কিছু উপহার পেয়েছিলেন। বন্ধুত্ব। যেখান থেকে লাফটা দিতে হবে, সেখানে একটা তোয়ালে ফেলে রাখার পরামর্শ পেয়েছিলেন ওয়েন্স। তাতে ডিসকোয়ালিফাইড হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। পরামর্শদাতা? সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী লুজ লং!

ওয়েন্স সোনা জেতায় রুপাজয়ী লং লাফিয়ে বালুর ওপর পড়ে তাঁকে শুভেচ্ছা জানান। তার আগে দুজন মিলে পাঁচবার অলিম্পিক রেকর্ড গড়েন। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিটলার সেদিন স্টেডিয়ামে এবং পরে লংকে নজরদারিতে রেখেছিল নাৎসিরা। ওয়েন্সের অলিম্পিক রেকর্ড স্থায়ী হলো ২৪ বছর।

পরের দিন (৫ আগস্ট), ২০০ মিটার জিতলেন ২০.৭ সেকেন্ডে। এবারও অলিম্পিক রেকর্ড। মাঝে তিন দিন পর ৪০০ মিটার রিলে জেতেন ওয়েন্স বিশ্ব রেকর্ড গড়ে (৩৯.৮ সেকেন্ড) জিতলেন ৮৯ বছর আগে আজকের দিনে।

প্রথম ব্যক্তি হিসেবে অলিম্পিকের এক আসরে চার সোনা! ইএসপিএনের ভাষায়, ‘হিটলারের আর্য শ্রেষ্ঠ মিথকে একাই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন।’

অথচ রিলে দৌড়ে ওয়েন্সের নামার কথা ছিল না। ১০০ মিটারে রুপাজয়ী রালফ মেটক্যাফেরও না। স্টোলার ও গ্লিকম্যানের নামার কথা ছিল। কিন্তু দৌড়ের দিন সকালে দুই ইহুদি স্টোলার ও গ্লিকম্যানকে বসিয়ে ওয়েন্স ও মেটক্যাফেকে নেন যুক্তরাষ্ট্রের স্প্রিন্ট কোচ লসন রবার্টসন। এ নিয়ে কখনোই অফিশিয়াল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তবে বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যমের দাবি, জার্মানদের ঠান্ডা রাখতেই ওই সিদ্ধান্ত।

পদক জয়ের লড়াইয়ে দৌড়ের নেতৃত্ব দেন ওয়েন্স। নিকটতম অ্যাথলেটের চেয়ে প্রায় ১৫ গজ এগিয়ে ল্যাপ শেষ করেন।

রিলে দৌড়ে যুক্তরাষ্ট্রের দলীয় বিশ্ব রেকর্ড টিকেছে ২০ বছর। ক্লিভল্যান্ডের রিসার্চ ইউনিভার্সিটি কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভের সাময়িকী ‘অবজারভার’–এর মতে, হিটলার অলিম্পিকের প্রথম দিন শুধু জার্মান অ্যাথলেটদের সঙ্গে হাত মেলান। কোনো পদক প্রদান অনুষ্ঠানে থাকেননি।

ওয়েন্সের সঙ্গে হিটলার হাত মিলিয়েছিলেন কি না, সেই প্রশ্নে তাঁর মেয়ে মার্লিনের ভাবনা, ‘আমার মনে হয় না। যেটা ঘটেছিল, হিটলারকে বলা হয়েছিল জার্মান অ্যাথলেটদের সঙ্গে হাত মেলালে বাকিদের সঙ্গেও মেলাতে হবে। কিন্তু তা না করে বাবার জয়ের পরই তিনি স্টেডিয়াম ছেড়ে যান। তাই হিটলারের সঙ্গে তার আসলে দেখা হয়নি।’

কিন্তু ওয়েন্স নিজেই বলে গেছেন, চ্যান্সেলরস বক্সের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হিটলার তাঁর প্রতি হাত নেড়েছিলেন।

নিষেধাজ্ঞা ও ‘অমানবিক’ দৌড়
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানে ২০০০ সালে গল্পটা বলেছিলেন ওয়েন্সের স্ত্রী মিনি রুথ। ওয়েন্সের বয়স যখন ১৫, তখন থেকে পরিচয় দুজনের। অলিম্পিকে দেশের হয়ে ইতিহাস গড়ার পর ওয়েন্সের নিষিদ্ধ হওয়ার গল্পটা রুথ বলেছিলেন, ‘ওই যে আভেরি ব্রান্ডেজ লোকটা, সে জেসির হৃদয়কে বিদীর্ণ করেছে।’

ওয়েন্স দেশে ফেরার পরপরই ইউরোপে তাঁর সফরের আয়োজন করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অলিম্পিক কমিটির প্রধান ব্রান্ডেজ। এ সংস্থা ছাড়াও আমেরিকান অ্যাথলেটিক ইউনিয়নের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা ছিল এ সফরের উদ্দেশ্য।

বার্লিনে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ইভেন্ট শেষ হওয়ার পরদিনই ইউরোপ সফরে বেরিয়ে পড়তে হয় ওয়েন্সকে। তাঁর শারীরিক ক্লান্তিকে কেউ ফুটো পয়সার মূল্যও দেয়নি। জার্মানির কোলনে লং জাম্প ও ১০০ মিটার দৌড় জেতার পর সেদিন পার্টিতে রাতের খাবার খেতে খেতে মধ্যরাত হয়ে গিয়েছিল। পরদিন সকালে আরেকটি প্রদর্শনী ইভেন্টের জন্য তাঁকে প্রাগে যেতে হবে। কিন্তু সকালে বিমানবন্দরে যখন পৌঁছালেন, ওয়েন্সের কাছে একটি টাকাও ছিল না। কয়েকজন যাত্রী তাঁকে দুধ ও স্যান্ডউইচ কিনে দেন। ওয়েন্সের এমন দেখভাল করছিলেন আয়োজকেরা যে অর্থ আসছিল ঠিকই কিন্তু যাঁকে ব্যবহার করে তাঁরা আয় করছিলেন, সেই ওয়েন্সের শরীর খারাপ হচ্ছিল। এমনকি এই সফরে ক্রয়ডন বিমানবন্দরে তাঁকে ফাঁকা হ্যাঙ্গারে ঘুমিয়েও রাত কাটাতে হয়। সেই সফর নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসকে ওয়েন্স বলেছিলেন, ‘কেউ না কেউ কোথাও না কোথায়ও অর্থ আয় করছে (এই সফর ঘিরে), আর আমরা সফরে একটি স্যুভেনিরও কিনতে পারিনি।’

ওয়েন্স সেই সফরে ১১ পাউন্ড ওজন হারান। সফরে থাকতেই নিজের দেশ থেকে বড় বড় স্পনসর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির ডাক পান। ‘দৌড়াতে দৌড়াতে অসুস্থ হয়ে পড়া’ ওয়েন্স এরপর আর দেরি করেননি। সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও নরওয়ে সফর রেখে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় তাঁর ক্যারিয়ারে।

আমেরিকান অ্যাথলেটিক ইউনিয়নের সচিব ড্যানিয়েল ফেরিসকে দিয়ে ব্রান্ডেজ ঘোষণা করান, ‘সব ধরনের অ্যামেচার অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতা থেকে ওয়েন্সকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা হলো।’

মাত্র ২৪ বছর বয়সেই শেষ হলো ওয়েন্সের অ্যাথলেটিক ক্যারিয়ার। এরপর শুরু হলো অন্য ক্যারিয়ার। যে ক্যারিয়ারে তাকালে স্রেফ একটি শব্দই মুখে উঠে আসতে পারে, ‘অমানবিক।’

সংসার চালাতে ওয়েন্স শুরুতে স্থানীয় নবিশ স্প্রিন্টারদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করলেন। তাঁদের ১০-২০ গজ এগিয়ে দিয়ে তারপর দৌড় শুরু করতেন। কিন্তু ব্যাপারটা একপেশে হয়ে ওঠায় অর্থও বেশি আসছিল না। ওয়েন্স বাধ্য হয়ে মোটরবাইক, গাড়ি, ঘোড়া ও কুকুরের সঙ্গে প্রদর্শনী দৌড় শুরু করলেন। অলিম্পিকে দেশের হয়ে ইতিহাস গড়া অ্যাথলেটকে শেষ পর্যন্ত নেমে আসতে হয় এতটাই। ভাবা যায়!

ব্যাপারটা বাস্তব বলেই একটি ঘটনার উল্লেখ করতে হয়।

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৩৬। কিউবার হাভানা। একটি ফুটবলের মাঝে বিরতি চলছিল। ওয়েন্স নেমে পড়লেন মাঠে। উপস্থিত প্রায় হাজার তিনেক মানুষকে বিনোদন দিতে তাঁকে দৌড়াতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম জুলিও ম্যাককাও। ওয়েনসের এজেন্ট ভেবেছিলেন এটা হবে ‘রেস অব দ্য সেঞ্চুরি’।

দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে সমতা আনতে ওয়েন্সকে ৪০ গজ এগিয়ে দৌড় শুরু করতে দেওয়া হলো। ৯.৯ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করে জিতলেন ওয়েন্স। তাঁর কাছে হেরেছে ম্যাককাও, যে আসলে একটি ঘোড়া!

অনেক পরে এসব দৌড় নিয়ে ওয়েন্স বলেছিলেন, ‘লোকে বলে একজন অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের জন্য ঘোড়ার সঙ্গে দৌড়ানো অপমানজনক। কিন্তু আমি কী করতে পারি? আমার কাছে চারটি সোনার পদক আছে। কিন্তু সোনার পদক তো খাওয়া যায় না।’

ওয়েন্সের তিন মেয়ের মধ্যে মার্লিনই এসব নিয়ে বেশি বলতেন। গার্ডিয়ানকে বলেছিলেন, ‘ওরা তার ক্যারিয়ার ও জীবনটাও ছিনিয়ে নিয়েছে।’

জীবনের শুরু ও শেষ যেভাবে
জেমস ক্লিভল্যান্ড ওয়েন্সের জন্ম ১৯১৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আলাবামার ওকভিলে। বাবা হেনরি ক্লিভল্যান্ড ওয়েন্স ছিলেন ‘শেয়ারক্রপার’ বা বর্গাচাষি। দাদা ছিলেন ক্রীতদাস। ওয়েনসের বয়স যখন ৯ বছর, তাঁর পরিবার ‘গ্রেট মাইগ্রেশন’–এর অংশ হিসেবে আলাবামা ছেড়ে ক্লিভল্যান্ডে স্থায়ী হয়।

ছোটবেলায় মুদিখানার পণ্য সরবরাহের পাশাপাশি গাড়িতে মাল তোলা ও জুতা সারানোর দোকানে কাজ করেছেন ওয়েন্স। এ সময় নিজের ভেতরে অবিশ্বাস্য ক্ষমতাটা টের পান—দৌড়াতে পারেন! ফেয়ারমন্ট জুনিয়র হাইস্কুলের কোচ ফ্রাঙ্ক রাইলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। স্কুলের আগে ও পরে ওয়েন্সকে সময় দিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, দৌড়ানোটা এই ছেলের সহজাত প্রতিভা।

এক বছর পর ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় রেকর্ড ভাঙতে শুরু করেন ওয়েন্স।

হিটলার হাত মেলানোর জন্য আমাকে নিমন্ত্রণ করেননি। তবে প্রেসিডেন্টও হাত মেলাতে হোয়াইট হাউসে আমাকে নিমন্ত্রণ জানাননি।
জেসি ওয়েন্স
তার আগেই একটি মজার কাণ্ড ঘটে। স্কুলে রোল কলের সময় তাঁর নামটা ভুলভাবে উচ্চারণ করেছিলেন শিক্ষক। ওয়েন্স উঠে দাঁড়িয়ে শিক্ষককে বলেন তাঁর নাম ‘জে সি’। কিন্তু ওয়েন্সের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের উচ্চারণ ঠিক ধরতে পারেননি শিক্ষক। তিনি ভেবে নেন নামটা ‘জেসি (jesse)’—ব্যস, তার পর থেকেই জেমস ক্লিভল্যান্ড ওয়েনস হয়ে গেলেন জেসি ওয়েন্স।

সেই ওয়েন্স বার্লিন অলিম্পিকে ইতিহাস গড়ে ফেরার পর তাঁর দেশ কিন্তু তাঁকে সেভাবে বরণ করে নেয়নি। বর্ণবাদের করাল থাবার কারণে ওয়ালডর্ফ আস্তুরিয়া হোটেলে তাঁর‌ জন্য আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁকেই শুরুতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি! শ্বেতাঙ্গদের ব্যবহার করা লিফট নয়, মালামাল তোলার লিফটে করে অনুষ্ঠানের কামরায় যেতে তাঁকে বাধ্য করা হয়।

ওয়েন্স বার্লিন থেকে ফেরার পর যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টও তাঁকে অভিনন্দনসূচক কোনো বার্তা পাঠাননি কিংবা হোয়াইট হাউসে নিমন্ত্রণ জানাননি। সাধারণত ক্রীড়াবিদেরা বড় সাফল্য পেলে তাঁদের হোয়াইট হাউসে নিমন্ত্রণ জানানোটা রীতি এবং সেটা এখনো পালন করা হয়। রুজভেল্ট শুধু শ্বেতাঙ্গ অ্যাথলেটদেরই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বার্লিন অলিম্পিকে অংশ নেওয়া ১৮ জন কৃঞ্চাঙ্গ অ্যাথলেটের কাউকেই রুজভেল্ট সম্মান জানাননি। কেউ কেউ বলেন দক্ষিণাঞ্চলের ভোটে ভাটার টান যেন না পড়ে, সেই ভাবনা থেকেই অমন করেছিলেন রুজভেল্ট। তবে ওয়েন্সের এসব নিয়ে বিকার ছিল না। শুধু একবার বলেছিলেন, ‘হিটলার হাত মেলানোর জন্য আমাকে নিমন্ত্রণ করেননি। তবে প্রেসিডেন্টও হাত মেলাতে হোয়াইট হাউসে আমাকে নিমন্ত্রণ জানাননি।’

ওয়েন্স কিন্তু জীবনের মোড় কিছুটা হলেও ঘোরাতে পেরেছিলেন। পঞ্চাশের দশকে ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’ অর্থাৎ প্রেরণাদায়ী বক্তব্য দেওয়ার চাকরি পান। পাশাপাশি জনসংযোগ ব্যবসায়ও নেমে পড়েন। ক্রীড়াঙ্গনের দূত হিসেবে গিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। জার্মানিতে একটি রাস্তার নামকরণ হয় তাঁর নামে। ১৯৭৬ সালে পান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পুরস্কার। ঠিক তত দিনে মৃত্যুও এগিয়ে আসতে শুরু করেছে।

৩৫ বছরের বেশি সময় সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস তাঁর ফুসফুসে ক্যানসার তৈরি করেছিল। ১৯৮০ সালের ৩১ মার্চ অ্যারিজোনায় ৬৬ বছর বয়সে মারা যান ওয়েন্স। তাঁর মৃত্যুতে নিউইয়র্ক টাইমসে লেখা হয়েছিল, ‘ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের ইতিহাসেই সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত অ্যাথলেট।’

‘গ্রেটেস্ট ৪৫ মিনিটস অব স্পোর্টস’
২৫ মে ১৯৩৫। মিশিগানে বিগ টেন মিট। ওয়েন্স এই প্রতিযোগিতায় তিনটি বিশ্ব রেকর্ড গড়েন এবং আরেকটি বিশ্ব রেকর্ড ছুঁয়েছিলেন। ১০০ গজ দৌড় দ্বিতীয়বারের মতো ৯.৪ সেকেন্ডে শেষ করেন। লং জাম্প, ২২০ গজ দৌড় ও ২২০ গজ লোয়ার হার্ডলসে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। ওয়েন্স এই কীর্তিগুলো করেছিলেন মাত্র ৪৫ মিনিটের মধ্যে। অনেকের মতেই তা ‘খেলাধুলার ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ৪৫ মিনিট’।

কিন্তু ওয়েন্স তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় বিবৃতিটা রেখেছিলেন বার্লিনের অলিম্পিয়াস্তাদিওনে। মুখে কিছু না বলে শুধু নিজের কাজটা করে যে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া যায়, ওয়েন্স তার চিরকালীন উদাহরণ।

শিকাগোয় লেক অব মেমোরিজে তাঁর সমাধিক্ষেত্রের কাছাকাছি পরিবারের বসবাস। পথচারীসহ তাঁর পরিবারের বিভিন্ন সদস্যরাও সেদিকে দিয়ে যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই চোখে পড়ে সমাধিক্ষেত্রে ফলকে লেখা একটি কথা—

‘একজন বিজয়ী, যিনি জানতেন জয়ই সবকিছু নয়।’

আরো পড়ুন
ব্যালন ডি’অর: কারা দেয়, কীভাবে দেয়
আরো পড়ুন
পিএসএলে ফের ডাক মারলেন সাকিব
আরো পড়ুন
হামজার পর এবার আসছেন সামিত সোম
আরো পড়ুন
Scroll to Top