শেখ জিল্লুর রহমান
মুমিনের জন্য একমাত্র জীবন ব্যাবস্থা ইসলাম। ইসলামে দ্বীন বলতে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থাকে বোঝায়, যা বিশ্বাস, নৈতিকতা এবং সামাজিক রীতিনীতি সহ জীবনের সকল দিককে অন্তর্ভুক্ত করে। দ্বীন শব্দের অর্থ ও তাৎপর্য শুধুমাত্র ধর্মীয় গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি একটি জীবন দর্শন যা ব্যক্তি ও সমাজের জন্য পথপ্রদর্শণ করে। ‘জীবন ব্যবস্থা’ শব্দটি দ্বারা সাধারণত জীবন পরিচালনার জন্য একটি নির্দিষ্ট নিয়ম বা পদ্ধতিকে বোঝায়। এটি একটি ব্যাপক ধারণা যা ব্যক্তি, সমাজ এবং প্রকৃতির বিভিন্ন দিক অন্তর্ভুক্ত করে। এটি ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক নিয়ম-কানুন সহ জীবনের সকল ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
একটি জীবন ব্যবস্থায় সাধারণত নিম্নলিখিত উপাদানগুলি অন্তর্ভুক্ত করে:
ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতি: ধর্মীয় অনুশাসন, উপাসনা পদ্ধতি, নৈতিকতা, এবং সামাজিক মূল্যবোধ।
সামাজিক নিয়ম ও প্রথা: রীতিনীতি, ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান, এবং সামাজিক সম্পর্ক।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা: উৎপাদন, বিতরণ, এবং সম্পদ ব্যবহারের নিয়মাবলী।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা: সরকার, আইন, এবং সমাজের পরিচালনা পদ্ধতি।
সাংস্কৃতিক উপাদান: ভাষা, শিল্পকলা, সাহিত্য, এবং জীবনযাত্রার পদ্ধতি।
ইসলাম যদি অন্যান্য ধর্মের মতো কতক অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্ম হতো তাহলে এ আলোচনার কোন প্রয়োজন হতো না। কারণ ধর্মের সাথে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই বলেই অন্যান্য ধর্মের নেতারা স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু ইসলাম ঐ ধরনের অনুষ্ঠান সর্বস্ব কোন ধর্ম নয়।
আল্লাহতায়ালা তায়ালা ইসলামকে দ্বীন অর্থাৎ জীবন ব্যবস্থা বলেছেন-“নিশ্চয় আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) হচ্ছে ইসলাম। আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের নিকট জ্ঞান আসার পরই তারা মতানৈক্য করেছে, পরস্পর বিদ্বেষবশত। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে কুফরী করে, নিশ্চয় আল্লাহ হিসাব গ্রহণে দ্রুত।”(সূরা আলে ইমরান-১৯)।
এ আয়াতটি থেকে স্পষ্ট যে ইসলামই একমাত্র জীবন ব্যবস্থা। ইসলামকে জীবন ব্যবস্থা হিসেবে যারা মানবে না বা ইসলামকে শুধুমাত্র ধর্ম হিসেবে মেনে অন্যকোনো জীবন ব্যবস্থা বা মতাদর্শকে গ্রহণ করবেন তারা আল্লাহর দেওয়া বিধান বা কোরানের আয়াতসমূহের সঙ্গে কুফরি করবে। ইসলাম ব্যতিত অন্যকোনো জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করা কুফির সামিল।
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, ‘‘তারা কি আল্লাহর দ্বীনের (জীবন ব্যাবস্থা) পরিবর্তে অন্য কিছু তালাশ করছে? অথচ আসমানসমূহ ও যমীনে যা আছে তা তাঁরই আনুগত্য করে ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় এবং তাদেরকে তাঁরই নিকট প্রত্যাবর্তন করা হবে”। (সূরা আল-ইমরান, ৮৩)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতে অনুসারী আলেমদের মতে কুফরী দুই প্রকার-
১. বড় কুফরীঃ যা মানুষকে দ্বীন থেকে বের করে দেয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) এবং তাঁর মনোনীত দ্বীন ইসলামকে গালি দিলে অথবা ইসলামের রুকন বা খুঁটিসমূহসহ আল্লাহতায়ালার দেওয়া সকল ফরজ বিধানের কোনো কিছুকে অস্বীকার করলে দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহ্র সাথে, তাঁর আয়াতের সাথে এবং তাঁর রাসূলের সাথে ঠাট্টা করতে? দ্বীন পালনে ওযর পেশ করো না, নিশ্চয় তোমরা ঈমান আনার পর (ঠাট্ট-বিদ্রূপের কারণে) কাফের হয়ে গেছ’ (সুরা, তাওবাহ, আয়াত: ৬৫-৬৬)।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, নিশ্চয় যারা কুফরী করে, তাদের মাল-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর আযাব থেকে কখনও কোন কাজে আসবে না এবং তারাই আগুনের জ্বালানি। (সুরা, আলে-ইমরান, আয়াত: ১০)
২. ছোট কুফরীঃ যেমনঃ আল্লাহ্র নে‘মত অস্বীকার করা অথবা কোনো মুসলিম ব্যক্তির সাথে অন্যায়ভাবে কলহ-বিবাদ ও মারামারি করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “মুসলিম ব্যক্তিকে গালি দেওয়া ফাসেক্বী এবং তার সাথে কলহ-বিবাদ ও মারামারি করা কুফরী”(সহীহ মুসলিম, হাদিস, আন্তর্জাতিক নম্বর ৬৪)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ১০ম হিজরীর ৯ই জিলহজ তারিখে আরাফার ময়দানে যখন বিদায় হজের ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন সূরা মায়েদার ৩ নম্বর আয়াতটি নাজিল হয়, এই আয়াতে আল্লাহ্ তায়ালা দ্বীনকে পরিপূর্ণ করার ঘোষণা দিয়েছেন এবং ইসলামকে একমাত্র জীবন ব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করার কথা বলেছেন। আয়াতটিতে বলা হয়েছে, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিআমত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য একমাত্র দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে।” (সূরা আল মায়েদা, আয়াত: ৩)
আয়াতগুলিতে আল্লাহতায়ালা জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামকেই মুসলিমদের জন্য একমাত্র দ্বীন হিসাবে উল্লেখ করেছেন। ইসলামকে আমরা ‘দ্বীন ইসলাম’ বলে থাকি। সাধারণ লোকেরা দ্বীন অর্থ ধর্ম মনে করে বলেই দ্বীন ইসলামের অনুবাদ করে ‘ইসলাম ধর্ম’।
আল্লাহ তা’আলা অন্য সূরায় বলেছেন, ‘আর যে নিজকে নির্বোধ বানিয়েছে, সে ছাড়া কে ইবরাহীমের আদর্শ থেকে বিমুখ হতে পারে? আর অবশ্যই আমি তাকে দুনিয়াতে বেছে নিয়েছি এবং নিশ্চয় সে আখিরাতে নেককারদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।’। (সূরা বাকারা, ১৩০)
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন (জীবন ব্যাবস্থা) তালাশ করে, তা কখনও তার নিকট থেকে গ্রহণ করা হবেনা। আর আখেরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত’। (সূরা আল-ইমরান, ৮৫)
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন, ‘তাদের কি এমন শরীক আছে, যারা তাদের জন্য এমন দ্বীন (জীবন ব্যাবস্থা) নির্ধারণ করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ্ দেন নি?’ (সূরা শুরা, ২১)
বর্তমানে ইসলামকে আমরা শুধু ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। আমরা মনে করি যে, ইসলাম হলো শুধু স্রষ্টাভিত্তিক কাজকর্ম। নামাজ পড়া, রোজা রাখা, হজ করা, যাকাত দেওয়া। ইসলামকে আমরা শুধু এসব গরিবের মধ্যেই রাখতে ভালোবাসি। কিন্তু ইসলাম যে পূর্ণাঙ্গ এক জীবনব্যবস্থা সেটা মানতে চাই না। আমাদের পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রতিটা ক্ষেত্রেই আল্লাহর কোরআন ও নবী মুহাম্মদ (সা.) এর হাদিস অনুসারে সার্বিক পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাকে ইসলাম বলে। শুধু নামাজ রোজাসহ ইসলাম শুধু পাঁচটি স্তম্ভেই সীমাবদ্ধ নয়। ইসলামের পরিধি ব্যাপক, বিস্তৃতি। ইসলামের প্রসারণ আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু, দোলনা থেকে কবর, পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত। আমাদের ইহকালীন-পরকালীন মুক্তি, শান্তির জন্য ইসলামই একমাত্র জীবনব্যবস্থা এবং পথপ্রদর্শক।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মুমিনগণ, তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না । নিশ্চয় সে তোমাদের জন্য স্পষ্ট শত্রু। (আল-বাকারা, আয়াত ২০৮ )
এ আয়াতে দ্বীনের নামে বিদআতেরও খন্ডন করা হয়েছে এবং বর্তমানের ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসীদের মতবাদও খন্ডন করা হয়েছে, যারা ইসলামকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়, বরং দ্বীনকে কেবল (ব্যক্তিগত) ইবাদত অর্থাৎ, মসজিদে সীমাবদ্ধ রেখে রাজনীতি এবং দেশের সংসদ থেকে তাকে নির্বাসন দিতে চায়।
দ্বীন শব্দের অর্থ আনুগত্য। আর ইসলাম মানে আত্মসমর্পণ। তাই দ্বীন ইসলাম অর্থ হলো আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণের ভিত্তিতে তাঁর আনুগত্যের বিধান। অর্থাৎ দ্বীন ইসলাম এমন একটি জীবনবিধান যা আল্লাহর নিকট পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও তাঁর পূর্ণ আনুগত্য দাবী করে।
ইসলামের বাস্তব রূপ হচ্ছে রসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের ৪০ বছর বয়স থেকে ৬৩ বছর পর্যন্ত যা করেছেন এর সবটুকুই আসল ইসলাম। তিনি মসজিদে ইমামতি করেছেন, মদীনায় রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন, যুদ্ধের ময়দানে সেনাপতিত্বও করেছেন। এ সবই তিনি আল্লাহর রসূল হিসাবে করেছেন। তাই দ্বীন ইসলামকে ব্যক্তি থেকে শুরুকরে রাষ্ট্র পর্যন্ত অর্থাৎ জীবনের সকল শাখায় প্রতিষ্ঠিতের জন্য চেষ্টা প্রচেষ্টা করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ ।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়াল বলেন, তিনি তোমাদের জন্য দীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; যে বিষয়ে তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর আমি তোমার কাছে যে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হল, তোমরা দীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না। (আশ-শূরা, আয়াত: ১৩)
কুরআন ও রসূলুল্লাহ (সা.) ওপর বিশ্বাসী সকলেই একথা স্বীকার করতে বাধ্য যে, জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা প্রচেষ্টা করাই হল ইসলামী রাজনীতির একটি দিক। মানুষের জীবনে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় দিক যেমন আছে, তেমনি রাজনৈতিক দিকও রয়েছে।
সুতরাং, আমাদের পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা সবক্ষেত্রেই ইসলাম আবশ্যক ভূমিকা পালন করে। পরিবারের সবার সাথে ভালো ব্যবহার করা, গরিব-এতিমের সাথে আচরণ, সমাজের একে অন্যের খোঁজ খবর নেওয়া সব ক্ষেত্রেই ইসলামের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ব্যক্তির আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ, কথার মাধুর্যতা সবখানেই ইসলামের গুরুত্ব, প্রভাব করেছে। ইসলাম মানুষকে মুক্তির আহ্বান করে, আত্মার পরিশুদ্ধি করে। ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির বিশ্বাস, ভালোবাসা তৈরি করে। প্রতিবেশীর হক আদায়, তাদের খোঁজ খবর নেওয়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করা, রোগ শোকে পাশে থাকা ইত্যাদি কাজের নির্দেশনা দেয় ইসলাম। পরিপূর্ণ ইসলামে প্রবেশ করলে মানুষের ইহকালে ও পরকালে মুক্তি মিলবে।