শেখ জিল্লুর রহমান
عَنِ الْحَارِثِ الأَشْعَرِيّ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: وَأَنَا آمُرُكُمْ بِخَمْسٍ اللَّهُ أَمَرَنِي بِهِنَّ: السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ وَالْجِهَادُ وَالْهِجْرَةُ وَالْجَمَاعَةُ فَإِنَّهُ مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ قِيدَ شِبْرٍ فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ إِلَّا أَنْ يَرْجِعَ, وَمَنْ ادَّعَى دَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ فَإِنَّهُ مِنْ جُثَا جَهَنَّمَ, فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ وَإِنْ صَلَّى وَصَامَ؟ قَالَ: وَإِنْ صَلَّى وَصَامَ, فَادْعُوا بِدَعْوَى اللَّهِ الَّذِي سَمَّاكُمْ الْمُسْلِمِينَ الْمُؤْمِنِينَ عِبَادَ اللَّهِ
হাদিসের অনুবাদঃ
হযরত হারিসুল আশয়ারী রা. থেকে বর্ণিত। নবী করীম সা. বলেছেন, আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি যেগুলোর ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। ১. জামায়াতবদ্ধ হবে (দলভুক্ত জীবন যাপন করবে) ২. নেতার আদেশ মন দিয়ে শুনবে ৩. তার আদেশ মেনে চলবে ৪. আল্লাহর পথে হিজরত করবে ৫. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে। আর তোমাদের মধ্য হতে যে সংগঠন হতে বিঘত পরিমাণ দূরে সরে গেল, সে তার গর্দান থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলল তবে যদি ফিরে আসে তা ভিন্ন কথা। আর যে ব্যক্তি জাহেলিয়াতের দিকে আহ্বান জানায় সে জাহান্নামি। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! সে যদি রোজা রাখে, নামাজ পড়ে এরপরও? রসূল সা. বললেন, যদি রোজা রাখে, নামাজ পড়ে এবং নিজেকে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করে এরপরও জাহান্নামি হবে। (আত তিরমিযি : ২৮৬৩, ই.ফা.)
হাদীসের গুরুত্বঃ এখানে ইসলামের এমন পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যা বাদ দিলে ইসলামী সমাজের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। ইসলামের যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য তাও ব্যর্থ হতে বাধ্য। ইসলামের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া সম্ভব নয়।
রাবি পরিচিতি: নাম: হারিস ইবনে হারিস আল-আশআরী আশ-শামী। কেউ কেউ বলেছেন, হারিস আল-আশআরী আবু মালিক আল-আশআরী নামেও পরিচিত। তার নামের ব্যাপারে এখতেলাফ আছে। কেউ বলেছেন, হারিস আল-আশআরী, আবু নাঈম ও আবু মালিক একই জন। (উসুদুল গাবা ফি মারিফাতিস সাহাবা) আবু সালাম আল আসওয়াদ বর্ণনা করেছেন, তার নাম ছিলো আবি সালাম মামতুর আল-হাবশী। কুনিয়াত: তার কুনিয়াত হচ্ছে আবু মালিক। তিনি আবু মালিক নামেই বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। জন্মস্থান: তার জন্মস্থান শাম দেশে। তিনি শাম দেশেই বসবাস করতেন। সেখানে তার অনেক বন্ধুবর মানুষ ছিলেন। তিনি সবার কাছে অত্যন্ত সম্মানের পাত্র ছিলেন। হজরত হারিস আল-আশআরী বর্ণিত হাদিস সংখ্যা একটা। যে হাদিসকে জ্ঞানের মূল উৎস বলা হয়।
হাদিসের ব্যাখ্যাঃ
হাদীসটির শুরুতেই রাসূল (সা:) আলাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে এ আদেশ দিয়েছেন।
১. জামায়াত বদ্ধ হওয়াঃ মূল শব্দ অর্থ হচ্ছে বিক্ষিপ্ত কোন বস্তুকে একত্রিত করা। এ থেকে অর্থ দল, জামায়াত, সংগঠন।
অর্থঃ “তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকতেই হবে যারা মানবজাতিকে কল্যানের পথে ডাকবে। (আল ইমরান-১০৪)
কোরআনের ভাষায় – সংগঠন
১)“তোমরা সংঘবদ্ধ ভাবে আলাহর রজ্জুকে আকড়ে ধর ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়োনা।” (আল ইমরান-১০৩)
২)“আর যে ব্যক্তি আলাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারন করবে সে অবশ্যই সত্য ও সঠিক পথ প্রদর্শিত হবে। (আল ইমরান-১০১)
৩)“আলাহ তায়ালা তো সেই সব লোকদেরকে ভালবাসেন যারা তার পথে এমনভাবে কাতারবন্দী হয়ে লড়াই করে যেন তারা সীসা ঢালা প্রাচীর।” (সফ-৪)
৪)“তোমরা সেসব লোকের মতো হয়োনা যারা বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং স্পষ্ট ও প্রকাশ্য নির্দেশ পাওয়ার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে, তাদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।” ( আল ইমরান-১০৫)
ইসলামী সংগঠনের বৈশিষ্ট্যঃ ইসলামী সংগঠনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ৩টি।
ক. ইসলামী নেতৃত্ব
খ. ইসলামী কর্মী বাহিনী
গ. ইসলামী পরিচালনা বিধি।
ক. ইসলামী নেতৃত্বঃ
ইসলামী নেতৃত্বকে খলিফা, ইমাম ও আমীর হিসেবে বলা হয়। কুরআনী একটি পরিভাষা হলো উলিল আমর।
ইসলামের নামে ……. খুলে তার প্রধান হয়ে বসলেই তাকে ইসলামী নেতৃত্ব বলে না।
ইসলামী নেতৃত্ব কোন পদের নাম নয়।
ইসলামী কর্মীবাহিনী কর্তৃক নির্বাচিত একটি পদ।
নেতৃত্বের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যঃ
জ্ঞানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বঃ রাসূল (সা:) বলেন- “জনগণের নেতা হবে সে যে আলাহর কিতাব সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞান রাখে।” (মিশকাত)
উন্নত আমলঃ “তোমাদের মধ্যে সেই সম্মানী যে আলাহকে ভয় করে।” (আল কুরআন)
নম্র ব্যবহারঃ “যে ব্যক্তি আলাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন ভালো ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।” (বুখারী)
ধৈর্য্যঃ “নিশ্চয়ই আলাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে থাকেন। (বাকারা)
সাহসিকতা; রাসূল (সা:) বলেন, “যে ব্যক্তি আলাহকে ভয় করে দুনিয়ার সবকিছু তাকে ভয় করে আর যে আলাহকে ভয় করেনা দুনিয়ার সবকিছু তাকে ভয় দেখায়। পরিশ্রম প্রিয়তা। কর্মীদের মাঝে ইনসাফ কায়েম।
পরামর্শ ভিত্তিক সিদ্ধান্তঃ
সৎ কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করা। কোন বিষয়ে তোমার মত সুদৃঢ় হয়ে গেলে আলাহর উপর ভরসা করো। (আল ইমরান)
ইসলামী নেতৃত্বের জবাবদিহিতাঃ
1. জনগনের কাছে।
2. আলাহর কাছে।
খ. ইসলামী কর্মী বাহিনীঃ বৈশিষ্ট্য দুটি
১. নেতার কথা মন দিয়ে শুনবে
২. তার আদেশ মেনে চলবে।
১) “হে ঈমানদারগণ! তোমরা রাসূলকে সম্বোধন করে রায়িনা বলোনা বরং তোমরা বল উনযুরনা এবং তার কথা মন দিয়ে শোন। (বাকারা-১০৪)
ভালো আদেশের আনুগত্য-
“নেতা যে পর্যন্ত কোন পাপকাজের আদেশ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার আদেশ শোন ও মেনে নেয়া প্রত্যেকটি মুসলমানের জন্য ফরজ তা তার পছন্দ হোক বা অপছন্দ হোক। তবে সে যদি কোন পাপকাজের আদেশ দেয় তবে তার আদেশ কোন বা আনুগত্য করা যাবেনা।” (বুখারী-মুসলিম)
২. “হে মূমিনগন তোমরা আলাহর আনুগত্য করো, রাসূলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের নেতার আনুগত্য করো।” (নিসা-৫৯)
রাসূল (সা:) বলেন : “যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল সে আলাহর আনুগত্য করল। যে আমার হুকুম অমান্য করল সে আলাহর হুকুম অমান্য করল। যারা আমীরের আনুগত্য করল তারা আমার আনুগত্য করল। আর যারা আমীরের আদেশ অমান্য করল তারা প্রকৃতপক্ষে আমার আদেশ অমান্য করল।” (বুখারী-মুসলিম)
“পাপ কাজে কোন আনুগত্য নেই, আনুগত্য কেবল ভালো কাজের ব্যাপারে।” “আমীর যদি কালো কুৎসিত হাবশী কৃতদাসও হয়, যার মাধা আঙ্গুরের মতো সে যদি নির্দিষ্ট সীমার ভেতর থেকে নেতৃত্ব দেয় তবে অবশ্যই তার আনুগত্য করতে হবে।” (আল-হাদীস)
৩. ইসলামী পরিচালনা বিধিঃ
পরিচালনা মৌলিক উৎস দুটি- কোরআন, সুন্নাহ।
কোরআন সমস্ত সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিধান।
“শাসন হুকুমের অধিকার একমাত্র আলাহর। তার নির্দেশ তোমরা আলাহ ছাড়া আর কারো দাসত্ব ও আনুগত্য করতে পারবে না।” (ইউসুফ-৪০)
“রাসূল তোমাদের জন্য যেসব বিধি বিধান ও আইন-কানুন এনেছেন তা গ্রহণ করো এবং যেসব বিষয়ে নিষেধ করেছেন তা থেকে দূরে থাকো।” (হাশর-৭) “যারা আলাহর বিধান দিয়ে বিচার ফায়সালা করেনা তারাই কাফের।” (মায়েদা-৪৫)
৪. হিজরতঃ চতুর্থ কাজ হলো হিজরত করা। হিজরত অর্থ- ত্যাগ করা, কোন জিনিস বা স্থান ত্যাগ করা, সম্পর্কচ্ছেদ করা।
পরিভাষায়ঃ একমাত্র আলাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে দারুল হরর থেকে দারুল ইসলামে প্রবেশ করা।
রাসূল (সা:) বলেন-
“শরীয়তের নিষিদ্ধ কাজ সমূহ পরিত্যাগ করা।”
৫. আলাহর পথে জিহাদঃ
জিহাদ অর্থ- সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, কঠোর পরিশ্রম, চুড়ান্ত সাধনা ইত্যাদি।
পারিভাষিক- আলাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে তার দ্বীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা চালানোর জিহাদ বলে।
জিহাদ সম্পর্কে কোরআন-
“জিহাদ তোমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে যদিও তা তোমাদের নিকট রহস্য মনে হচ্ছে।”
“আলাহর পথে জিহাদ কর যেমন জিহাদ করা উচিত।” (হাজ্জ-৭৮)
“ঈমানদাররা লড়াই করে আলাহর পথে আর কাফিররা লড়াই করে তাগুতের পথে।” (নিসা-৭৬)
রাসূল (সা:) বলেন-
“যে ব্যক্তি জিহাদ করল না, জিহাদের চিন্তা ভাবনাও করলনা; আর এ অবস্থায় মৃত্যু বরন করল সে যেন মুনাফিকের মৃত্যু বরন করল।” (মুসলিম)
জিহাদ কখনও ফরজে আইন, কখনও ফরজে কিফায়া।
শিক্ষাঃ
- ইসলাম কখনই এককভাবে পালনের নিমিত্তে অবতীর্ণ নয় বরং জামায়াতদ্ধতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি জীবনে পালনীয় বিষয়।
- যোগ্য নেতৃত্ব, আদেশ ও আনুগত্যের ভারসাম্য ইসলামী সংগঠনের প্রাণ।
- জিহাদের মাধ্যমে সমাজ বিপব এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য।
বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের কোনো একটিতে যোগ দেওয়া কি একজন মুসলিমের উপর আবশ্যকীয়?
ইমাম মালেক (রহঃ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্ববরের দিকে ইশারা করে বলেন, ‘এ ক্ববরের অধিবাসী ব্যতীত পৃথিবীর সকল ব্যক্তির কথা গ্রহণীয় ও বর্জনীয়’। অর্থাৎ শুধুমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিটি কথাই গ্রহণীয়। আর নির্দিষ্ট কোনো দল বা সংগঠনে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে আমি বলব, মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল উম্মতকে জামা‘আতবদ্ধভাবে জীবন যাপন করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘জামা‘আতের সাথে আল্লাহর হাত থাকে’ (তিরমিযী, হা/ ২১৬৭, শায়খ আলবানী হাদীছটিকে ‘ছহীহ’ বলেছেন)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমাদের উপর জামা‘আতবদ্ধ থাকা ফরয করা হল। কেননা নেকড়ে বাঘ একাকী দূরে অবস্থানকারী ছাগলকে খেয়ে ফেলে’ (নাসাঈ, হা/৮৪৭, শায়খ আলবানী হাদীছটিকে ‘হাসান’ বলেছেন)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘শয়তান একক ব্যক্তির সঙ্গে থাকে এবং সে দু’জন থেকে দূরে থাকে’ (তিরমিযী, হা/২১৬৫, শায়খ আলবানী হাদীছটিকে ‘ছহীহ’ বলেছেন)। এছাড়া এ প্রসঙ্গে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।
সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ, আল্লাহর পথে দা‘ওয়াত, শার‘ঈ জ্ঞানার্জন, হক ও ধৈর্য্যের উপদেশ ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর আনুগত্যের ক্ষেত্রে প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির একে অপরকে সহযোগিতা করা নিঃসন্দেহে শরীআ‘তসম্মত কাজ। আর একতাবদ্ধভাবে এসব কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে শয়তানের কবল থেকে রক্ষা করতে পারে, যা উপরোল্লেখিত হাদীছসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয়। সংঘবদ্ধভাবে এসব কাজ সম্পাদ মহান আল্লাহ্র নিম্নোক্ত বাণীর আওতায়ও পড়ে:
﴿ وَٱلۡعَصۡرِ ١ إِنَّ ٱلۡإِنسَٰنَ لَفِي خُسۡرٍ ٢ إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلۡحَقِّ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلصَّبۡرِ ٣ ﴾ [العصر: ١، ٣]
‘সময়ের কসম! নিশ্চয়ই মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তবে তারা ব্যতীত, যারা ঈমান এনেছে, সৎকর্ম করেছে এবং পরস্পরকে হক ও ধৈর্য্যের উপদেশ দিয়েছে’ (আল-আছর)।
ইসলামী সংগঠন, নেতা নির্বাচন ও বায়াত গ্রহণ
শায়খ আলী আল-হালাবী বায়‘আত সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বায়‘আত সম্পর্কে অনেকগুলি সংশয় এবং সেগুলোর জবাব দিয়েছেন। নীচে আমাদের বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত পঞ্চম সংশয়টির বঙ্গানুবাদ করা হলঃ
পঞ্চম সংশয়ঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তিন জন সফরে বের হলে তারা তাদের একজনকে আমীর হিসাবে নিযুক্ত করবে’। উক্ত হাদীছে সফর অবস্থায় আমীর নিযুক্ত করার অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়েছে। সফর অবস্থায় যদি এই বিধান বলবৎ থাকে, তাহলে আল্লাহর পথে দা‘ওয়াতী ক্ষেত্রে মুক্বীম অবস্থায় আমীর নিযুক্ত করে শপথ ও বায়‘আত গ্রহণ ওয়াজিব হওয়া অধিকতর যুক্তিসঙ্গত নয় কি?
অনেকে আলেমগণ হদিসটিকে সফরের জন্য প্রযোজ্য বললেও বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন, কেননা ওই সময় একমাত্র মদীনার রাষ্ট্রই একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র ছিল, যেখানে রাসুল সালাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম এক মাত্র আমীর, রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন তখন মদিনায় বসবাসরত সকল মুসলিমের জন্য তার নির্দেশনা হুকুম মানা ফরজ ছিল । এই ভুমি থকে কেউ বেরিয়ে কোথাও সফরে গেলে তার জন্য কি হবে? তখন কি বিছিন্ন ভাবে যাতায়াত করবেন? না! তাকে অবশ্যই রাসুল (সা.) এই হাদিস মেনে একজনকে আমীর মেনে তার নিকট বায়াত গ্রহণ করে তার নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। ঠিক একই ভাবে মদীনা রাষ্ট্র থেকে রাসুল (সা.) নির্দেশে অন্য ভূমিতে হিজরত বা নতুন ভূমি শাসনের জন্য শাসক নির্ধারনের করলে অবশ্যই নতুন ভূমির বাসিন্দারা রাসুল (সা.)-এর নির্ধারিত শাসকের নিকট বায়াত গ্রহণ করে তার নির্দেশনা মেনে চলতে হবে অথবা অমুসলিম বা অন্য ইসলাম ছাড়া অন্য জীবন ব্যবস্থার রাষ্ট্র যেমন সেকুলারিজম, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম দ্বারা পরিচালিত কোনো রাষ্ট্রে মুসলিম দাবিদাররা কি বিছিন্ন ভাবে বসবাস করবেন? আপনাদের যুক্তিতে কি বলে? অবশ্যই না?
প্রথমত, হিজরতের আমির নির্ধারণ নিয়ে একটি ঘটনা শুনি, মক্কায় অন্যায় অত্যাচারের উল্লেখিত বিভীষিকাময় ধারা-প্রক্রিয়া ও কার্যক্রম সূচিত হয় রাসুল (সা.)-এর নবুওয়তের চতুর্থ বর্ষের মধ্যভাগে কিংবা শেষের দিক থেকে। জুলুম নির্যাতনের শুরুতে এর মাত্রা ছিল সামান্য। কিন্তু দিনের পর দিন মাসের পর মাস সময় যতই অতিবাহিত হতে থাকল জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা ততই বৃদ্ধি পেতে পেতে পঞ্চম বর্ষের মধ্যভাগে তা চরমে পৌঁছল এবং শেষ পর্যন্ত এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হল যে, মক্কায় মুসলিমদের টিকে থাকা এক রকম অসম্ভব হয়ে উঠল। তাই এ বিভীষিকার কবল থেকে পরিত্রাণ লাভের উদ্দেশ্যে তাঁরা বাধ্য হলেন পথের সন্ধানে প্রবৃত্ত হতে। অনিশ্চয়তা এবং দুঃখ-দুর্দশার এ ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যে অবতীর্ণ হল সূরাহ যুমার।
এতে হিজরতের জন্য ইঙ্গিত প্রদান করে বলা হয় যে, ‘আল্লাহর জমিন অপ্রশস্ত নয়।’
(لِلَّذِيْنَ أَحْسَنُوْا فِيْ هَذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةٌ وَأَرْضُ اللهِ وَاسِعَةٌ إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُوْنَ أَجْرَهُم بِغَيْرِ حِسَابٍ) [الزمر:10]
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর। এ দুনিয়ায় যারা ভাল কাজ করবে, তাদের জন্য আছে কল্যাণ। আল্লাহর যমীন প্রশস্ত (এক এলাকায় ‘ইবাদাত-বন্দেগী করা কঠিন হলে অন্যত্র চলে যাও)। আমি ধৈর্যশীলদেরকে তাদের পুরস্কার অপরিমিতভাবে দিয়ে থাকি।’ (আয-যুমার ৩৯ : ১০)
অত্যাচারের মাত্রা যখন ধৈর্য ও সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেল, বিশেষ করে কুরআন মাজীদ পড়তে এবং নামায আদায় করতে না দেয়ার মানসিক যন্ত্রণা যখন চরমে পৌঁছল তখন তারা দেশান্তরের কথা চিন্তাভাবনা করতে শুরু করলেন। তিনি বহু পূর্ব থেকেই আবিসিনিয়ার সম্রাট আসহামা নাজ্জাশীর উদারতা এবং ন্যায় পরায়ণতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। অধিকন্তু, সেখানে কারো প্রতি যে কোন অন্যায়-অত্যাচার করা হয় না সে কথাও তিনি জানতেন। মুসলিম সেখানে গমন করলে নিরাপদে থাকার এবং নির্বিঘ্নে ধর্ম কর্ম করার সুযোগ লাভ করবে। এ সব কিছু বিচার-বিবেচনা করে তাঁদের জীবন এবং ঈমানের নিরাপত্তা বিধান এবং নির্বিঘ্নে ইসলাম পালনের সুযোগ লাভের উদ্দেশ্যে হিজরত করে আবিসিনিয়ায় গমনের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীগণ (রাঃ)-কে নির্দেশ প্রদান করেন।
জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব বললেন, হে বাদশাহ! আমাদের ধর্মের নাম ‘ইসলাম’। আমরা স্রেফ আল্লাহর ইবাদত করি এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করি না। বাদশাহ বললেন, কে তোমাদের এসব কথা শিখিয়েছেন? জা‘ফর বললেন, আমাদের মধ্যকারই একজন ব্যক্তি। ইতিপূর্বে আমরা মূর্তিপূজা ও অশ্লীলতা এবং অন্যায় ও অত্যাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলাম। আমরা শক্তিশালীরা দুর্বলদের শোষণ করতাম। এমতাবস্থায় আল্লাহ মেহেরবানী করে আমাদের মধ্যে তাঁর শেষনবীকে প্রেরণ করেছেন। তাঁর নাম ‘মুহাম্মাদ’। তিনি আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছেন। তাঁর বংশ মর্যাদা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারী, সংযমশীলতা, পরোপকারিতা প্রভৃতি গুণাবলী আমরা জানি। নবুঅত লাভের পর তিনি আমাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন এবং মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করে সর্বাবস্থায় এক আল্লাহর ইবাদত করার আহবান জানিয়েছেন। সাথে সাথে যাবতীয় অন্যায়-অপকর্ম হ’তে তওবা করে সৎকর্মশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং এক আল্লাহর ইবাদত করছি ও হালাল-হারাম মেনে চলছি। এতে আমাদের কওমের নেতারা আমাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং আমাদের উপর প্রচন্ড নির্যাতন চালিয়েছেন। সেকারণ বাধ্য হয়ে আমরা সবকিছু ফেলে আপনার রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছি আপনার সুশাসনের খবর শুনে। আমরা অন্যস্থান বাদ দিয়ে আপনাকে পসন্দ করেছি এবং আপনার এখানেই আমরা থাকতে চাই। আশা করি আমরা আপনার নিকটে অত্যাচারিত হব না’।
অতঃপর জাফর বললেন, হে বাদশাহ! অভিবাদন সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাদের জানিয়েছেন যে, জান্নাত বাসীদের পরস্পরে অভিবাদন হ’ল ‘সালাম’ এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে পরস্পরে ‘সালাম’ করার নির্দেশ দিয়েছেন’।
বাদশাহ বললেন, ঈসা ও তাঁর দ্বীন সম্পর্কে তোমরা কি বলতে চাও? উত্তরে জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব সূরা মারিয়ামের শুরু থেকে ৩৬ পর্যন্ত আয়াতগুলি পাঠ করে শুনান। যেখানে হযরত যাকারিয়া ও ইয়াহইয়া (আ.)-এর বিবরণ, মারিয়ামের প্রতিপালন, ঈসার জন্মগ্রহণ ও লালন-পালন, মাতৃক্রোড়ে কথোপকথন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। বাদশাহ ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এবং তাওরাত-ইঞ্জীলে পন্ডিত ব্যক্তি। কুরআনের অপূর্ব বাকভঙ্গি, শব্দশৈলী ও ভাষালংকার এবং ঘটনার সারবত্তা উপলব্ধি করে বাদশাহ অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকলেন। সাথে উপস্থিত পাদ্রীগণও কাঁদতে লাগলেন। তাদের চোখের পানিতে তাদের হাতে ধরা ধর্মগ্রন্থগুলি ভিজে গেল। অতঃপর নাজাশী বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই এই কালাম এবং ঈসার নিকটে যা নাযিল হয়েছিল দু’টি একই আলোর উৎস থেকে নির্গত’। বলেই তিনি কুরায়েশ দূতদ্বয়ের দিকে ফিরে বললেন, ‘তোমরা চলে যাও! আল্লাহর কসম! আমি কখনোই এদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দেব না’।
আমর ইবনুল ‘আছ এবং আব্দুল্লাহ ইবনু আবী রাবী‘আহ দরবার থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমর বললেন, কালকে এসে এমন কিছু কথা বাদশাহকে শুনাবো, যাতে এদের মূলোৎপাটন হয়ে যাবে এবং এরা ধ্বংস হবে। একথা শুনে আব্দুল্লাহ বললেন, না, না এমন নিষ্ঠুর কিছু করবেন না। ওরা আমাদের স্বগোত্রীয় এবং নিকটাত্মীয়। কিন্তু আমর ওসব কথায় কর্ণপাত করলেন না।
পরের দিন বাদশাহর দরবারে এসে তিনি বললেন, ‘হে সম্রাট! এরা ঈসা ইবনে মারিয়াম সম্পর্কে ভয়ংকর সব কথা বলে থাকে’। একথা শুনে বাদশাহ মুসলমানদের ডাকালেন। মুসলমানেরা একটু চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কেননা নাছারারা ঈসাকে উপাস্য মানে। কিন্তু মুসলমানরা তাকে ‘আল্লাহর বান্দা’ (عَبْدُ الله) বলে থাকে। যাই হোক কোনরূপ দ্বৈততার আশ্রয় না নিয়ে তারা সত্য বলার ব্যাপারে মনস্থির করলেন। অতঃপর আল্লাহর উপর ভরসা করে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সত্য প্রকাশ করে দিয়ে জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব বললেন,هُوَ عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ وَرُوحُهُ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إلَى مَرْيَمَ الْعَذْرَاءِ الْبَتُولِ ولم يَمَسُّها بَشَرٌ ‘তিনি ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। তিনি ছিলেন আল্লাহ প্রেরিত রূহ এবং তাঁর নির্দেশ। যা তিনি মহীয়সী কুমারী মাতা মারিয়ামের উপরে ফুঁকে দিয়েছিলেন। কোন পুরুষ লোক তাকে স্পর্শ করেনি’। তখন নাজাশী মাটি থেকে একটা কাঠের টুকরা উঠিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তুমি যা বলেছ, ঈসা ইবনে মারিয়াম তার চাইতে এই কাষ্ঠখন্ড পরিমাণও বেশী ছিলেন না’। তিনি জাফর ও তার সাথীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘যাও! তোমরা আমার দেশে সম্পূর্ণ নিরাপদ। যে ব্যক্তি তোমাদের গালি দিবে, তার জরিমানা হবে (৩বার)। তোমাদের কাউকে কষ্ট দেওয়ার বিনিময়ে যদি কেউ আমাকে স্বর্ণের পাহাড় এনে দেয়, আমি তা পসন্দ করব না’। অতঃপর তিনি কুরায়েশ দূতদ্বয়ের প্রদত্ত উপঢৌকনাদি ফেরৎ দানের নির্দেশ দিলেন।
ঘটনার বর্ণনাদানকারিণী প্রত্যক্ষ সাক্ষী হযরত উম্মে সালামাহ (রাঃ) (পরবর্তীকালে উম্মুল মুমেনীন) বলেন, ‘অতঃপর ঐ দু’জন ব্যক্তি চরম বেইযযতির সাথে দরবার থেকে বেরিয়ে গেল… এবং আমরা উত্তম প্রতিবেশীর সাথে উত্তম গৃহবাসীরূপে বসবাস করতে থাকলাম’ (ইবনু হিশাম ১/৩৩৩-৩৮; আহমাদ হা/১৭৪০; যাদুল মা‘আদ ৩/২৬; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ১১৫, সনদ ছহীহ)।
এখানে নেতার আদেশ মানতে হলে অবশ্যই ‘বাইয়াত’’ বা ‘‘আনুগত্যের শপথ’’ সর্বদা বজায় রাখতে হয়েছে। তাহলে রাষ্ট্র ছাড়া বায়াত গ্রহণ করা যাবে না এই অগ্রহণ যোগ্য। নেতার আদেশ মানা না মানা অবশ্যই তার নিকট অঙ্গীকার বা বায়াতগ্রহণ বড় ধরনের পাথর্ক্য তৈরি করে।
লেখক: প্রাবন্ধিক