কুরআনে বর্ণিত 'দ্বীন' ধর্ম না জীবন ব্যবস্থা

কুরআনে বর্ণিত ‘দ্বীন’ ধর্ম না জীবন ব্যবস্থা

শেখ জিল্লুর রহমান

কুরআনে বর্ণিত ‘দ্বীন’ ধর্ম না জীবন ব্যবস্থা? পবিত্র কুরআনে ব্যবহৃত ‘দ্বীন’ (الدين) শব্দটি ইসলামি ধর্মতত্ত্বের একটি মৌলিক ও কেন্দ্রীয় পরিভাষা। এটি কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা আচার-অনুষ্ঠানকে বোঝায় না, বরং মানুষের ঈমান (বিশ্বাস), আখলাক (চরিত্র) এবং আমল (কর্ম) সহ ঐশী আইন মেনে চলার এক সামগ্রিক জীবনধারাকে নির্দেশ করে। আধুনিক ইসলামি পণ্ডিতরা ‘দ্বীন’কে সংকীর্ণ ‘ধর্ম’ (Religion) শব্দের ঊর্ধ্বে একটি ‘সার্বিক জীবন ব্যবস্থা’ বা ‘Code of Life’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য হলো কুরআনে ‘দ্বীন’ শব্দের প্রয়োগের সংখ্যাগত যথার্থতা যাচাই করা এবং শব্দটির বহুমাত্রিক অর্থকে তাফসীর ও ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে একটি পূর্ণাঙ্গ কাঠামো প্রদান করা।

‘দ্বীন’ শব্দের গুরুত্ব এই কারণে যে, এটি সামাজিক ন্যায়বিচার, নৈতিক মূল্যবোধ এবং শাসনতান্ত্রিক কাঠামোসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর অর্থগত গভীরতা উপলব্ধির জন্য শব্দটির বহুমুখী অর্থ (Polysemy) বিশ্লেষণ অপরিহার্য। শব্দটি প্রধানত বিচার, আনুগত্য, প্রতিদান, এবং ধর্মমত—এই চারটি ধারণাকে একীভূত করে।

ফ্রিকোয়েন্সি বিতর্ক নিরসন: জনপ্রিয় ধারণা অনুযায়ী, কুরআনে ‘দ্বীন’ শব্দটি ৯৮ বার ব্যবহৃত হয়েছে। তবে ভাষাতাত্ত্বিক ও কর্পাস বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই সংখ্যাটি আরও সূক্ষ্ম পর্যালোচনার দাবি রাখে। আরবি দ-ই-ন (دين) মূল ধাতু থেকে উদ্ভূত শব্দগুলোর নির্ভুল পরিসংখ্যান নিম্নরূপ:

  • বিশেষ্য ‘দীন’ (دِين) (জীবন ব্যবস্থা, ধর্ম, প্রতিদান অর্থে): ৯২ বার
  • বিশেষ্য ‘দায়ন’ (دَيْن) (ঋণ বা দেনা অর্থে): ৫ বার
  • কৃতকর্ম বিশেষ্য ‘মাদী-নী-ন’ (مَدِينِين) (কর্মফল প্রাপ্ত অর্থে): ২ বার

সুতরাং, দ-ই-ন মূল থেকে উদ্ভূত শব্দের মোট প্রয়োগ সংখ্যা ৯৯ বার। জীবন ব্যবস্থা, ধর্ম, প্রতিদান অর্থে ‘দ্বীন’ শব্দটি ৯২ বার ব্যবহৃত হয়েছে, যা ‘৯৮ বার’ সংক্রান্ত প্রচলিত ধারণার একটি সুনির্দিষ্ট রূপ প্রদান করে।

‘দ্বীন’ শব্দের অর্থগত ব্যাপকতা এর মূল ধাতু দ-ই-ন (D-Y-N) এবং তার ঐতিহাসিক ব্যুৎপত্তির মধ্যে নিহিত। ‘আদর্শ’ আরবি অভিধান অনুযায়ী, এই মূল থেকে উদ্ভূত ক্রিয়া ‘দানা’ (دَانَ)-এর প্রধান চারটি অর্থ বিদ্যমান: বশ্যতা/পরাভূত করা, আনুগত্য/আত্মসমর্পণ, শাসন/কর্তৃত্ব, এবং বিচার/প্রতিদান। এই অর্থগুলো থেকে বোঝা যায় যে ‘দ্বীন’ সর্বদা একটি দ্বিমুখী সম্পর্ক নির্দেশ করে: একদিকে মানুষের পক্ষ থেকে আনুগত্য এবং অন্যদিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিচার ও কর্তৃত্ব।

শব্দটির ব্যুৎপত্তি নিয়ে দুটি প্রধান মত প্রচলিত আছে। প্রথমত, এটি একটি সেমেটিক উৎস থেকে আগত, যা হিব্রু (dīn) এবং আরামাইক (dīnā) ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এর অর্থ ‘বিচার’ বা ‘আইন’। কুরআনে ব্যবহৃত ‘ইয়াওমুদ-দ্বীন’ (يَوْمِ الدِّينِ) বা ‘বিচার দিবস’ এই অর্থকে সমর্থন করে। দ্বিতীয়ত, এটি মধ্য পারস্যের dēn শব্দ থেকে এসেছে, যা ধর্ম বা জীবনব্যবস্থার ধারণা প্রকাশ করে এবং একটি ইন্দো-ইরানীয় প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়। আধুনিক গবেষকদের মতে, কুরআন এই দ্বিমুখী ব্যুৎপত্তিকে অলঙ্কারিকভাবে কাজে লাগিয়ে ‘ঋণ’ (দায়ন) এবং ‘বিচার’ (দ্বীন)-এর ধারণাকে একীভূত করে ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করেছে। এই ভাষাগত সংযোগ এক গভীর ধর্মতাত্ত্বিক বার্তা প্রদান করে: মানুষ আল্লাহর কাছে ঋণী এবং এই ঋণ পরিশোধের পদ্ধতিই হলো তাঁর নির্দেশিত জীবন ব্যবস্থা (দ্বীন), যার চূড়ান্ত ফল বিচার দিবসে প্রকাশিত হবে।

কুরআনে ‘দ্বীন’ শব্দের অর্থগত শ্রেণিবিন্যাস

কুরআনের ৯২টি প্রয়োগের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে ‘দ্বীন’ শব্দের প্রধান চারটি স্বতন্ত্র কিন্তু আন্তঃসম্পর্কিত অর্থ পাওয়া যায়:

১. বিচার, প্রতিফল ও জবাবদিহিতা: এটি ‘দ্বীন’ শব্দের আদি সেমেটিক অর্থ, যা কর্মের চূড়ান্ত ফলকে বোঝায়। যেমন, সূরা আল-ফাতিহার চতুর্থ আয়াতে “মালিকি ইয়াওমিদ-দ্বীন” (مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ) বা ‘বিচার দিনের মালিক’ বলে আল্লাহকে চূড়ান্ত বিচারক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

২. আনুগত্য, বশ্যতা ও দাসত্ব: এই অর্থে দ্বীন আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়ে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণের আধ্যাত্মিক দিকটি নির্দেশ করে। সূরা আয-যুমারের দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, “ফা’বুদিল্লাহ মুখলিস্বাল লাহুদ-দ্বীন” (فَٱعْبُدِ ٱللَّهَ مُخْلِصًا لَّهُ ٱلدِّينَ) অর্থাৎ, ‘অতএব, আল্লাহর ইবাদত করো তাঁরই আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে।’

৩. সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা, আইন ও কর্তৃত্ব: এই অর্থে ‘দ্বীন’ একটি পূর্ণাঙ্গ কাঠামোকে বোঝায়, যা সামাজিক আইন, প্রশাসন এবং নৈতিক জীবনধারাকে অন্তর্ভুক্ত করে। সূরা আলে ইমরানের ১৯তম আয়াতে “ইন্নাদ-দ্বীনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম” (إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلَامُ) বা ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য জীবন ব্যবস্থা হলো ইসলাম’ বলে এই ব্যাপক অর্থটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

৪. ধর্মমত, মিল্লাত ও বিশ্বাস: এই অর্থে ‘দ্বীন’ একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় বা মতাদর্শিক পথকে অন্য পথ থেকে পৃথক করতে ব্যবহৃত হয়। এর সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ হলো সূরা আল-কাফিরুনের শেষ আয়াত: “লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন” (لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ) অর্থাৎ, ‘তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য, আর আমার দ্বীন আমার জন্য।’

‘দ্বীন’ বনাম ‘ধর্ম’: ধারণাগত পার্থক্য

‘দ্বীন’ শব্দের প্রচলিত বাংলা অনুবাদ ‘ধর্ম’ বা ইংরেজি ‘Religion’ এর ধারণাগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ‘ধর্ম’ শব্দটি প্রায়শই ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকতা বা আচার-সর্বস্বতাকে বোঝায়, যা মানবসৃষ্টও হতে পারে। কিন্তু ইসলামি পরিভাষায় ‘দ্বীন’ একটি সর্বজনীন ও সামগ্রিক ব্যবস্থা, যা বিশ্বাস (ঈমান), আচরণ (ইহসান) এবং আইন (শরিয়াহ)—সবকিছুকে ধারণ করে। ইসলামি আইনের অর্ধেকের বেশি অংশ সামাজিক সম্পর্ক (মু’আমালাত) নিয়ে গঠিত, যা প্রমাণ করে যে ‘দ্বীন’ কেবল ব্যক্তিগত বিষয় নয়, বরং এটি ন্যায়বিচার, করুণা এবং সামাজিক কল্যাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ‘দ্বীন’-কে ‘ধর্ম’ হিসেবে অনুবাদ করলে এর সামাজিক ও শাসনতান্ত্রিক দিকগুলো উপেক্ষিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

উপরিউক্ত বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে, পবিত্র কুরআনে ‘দ্বীন’ শব্দটি ধর্মতাত্ত্বিক বিশেষ্য হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে ৯২ বার ব্যবহৃত হয়েছে। এটি কোনো একক অর্থবোধক শব্দ নয় বরং একটি বহু-অর্থজ্ঞাপক পরিভাষা, যা বিচার, আনুগত্য, জীবন ব্যবস্থা ও ধর্মমত—এই চারটি প্রধান ধারণাকে ধারণ করে। ‘দ্বীন’ হলো আল্লাহর কাছে মানুষের দায়বদ্ধতা (দায়ন) পরিশোধের একটি পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি, যার চূড়ান্ত হিসাব বিচার দিবসে (ইয়াওমুদ-দ্বীন) নেওয়া হবে। সুতরাং, ইসলামে ‘দ্বীন’ কেবল একটি ‘ধর্ম’ নয়, বরং মানবজীবনের সকল দিককে অন্তর্ভুক্তকারী একটি সর্বজনীন ও কার্যকরী ঐশী ব্যবস্থা, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক, শিক্ষার্থী মাদানি নেসাব, ইকরা ফাউন্ডেশন

আরো পড়ুন
জাতীয়তাবাদকে (Nationalism) ইসলামের দৃষ্টিতে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ আল-আসাবিয়্যাহ (العصبية) বা জাহেলিয়াতের অপসংস্কৃতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন অনেকে। জাতীয়তাবাদকে ইসলাম বিরোধী একটি কুফরি মতবাদ বা মারাত্মক বিদআত এবং এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন অনেক আলেমেদ্বীন। জাতীয়তাবাদ মূলত ইসলাম দ্বারা নিষিদ্ধ 'আল-আসাবিয়্যাহ' (অন্ধ গোত্রপ্রীতি/দলপ্রীতি) এর আধুনিক রূপ।
আরো পড়ুন
রাষ্ট্রকে ইসলাম থেকে পৃথক করা ঈমান ভঙ্গের কারণ
আরো পড়ুন
Islam
আরো পড়ুন
ইবাদাত হচ্ছে আল্লাহতায়ালার বন্দেগী ও গোলামী করা
আরো পড়ুন
মুসলিমদের একমাত্র আদর্শিক নেতা মুহাম্মাদ (সা.)
আরো পড়ুন
দ্বীন প্রতিষ্ঠায় সংঘবদ্ধ জীবনযাপন মুমিনের জন্য ফরয
আরো পড়ুন
Scroll to Top